রক্তারক্তি: হুড়ার শিমুলতলার মাঠে চলছে মোরগের লড়াই। ছবি: সুজিত মাহাতো
মাঠের নাম শিমুলতলা। চার দিকে শিমুল আর পলাশ গাছ। লাল ফুল ধরতে শুরু করেছে। নীচের মাটিতে লাল ঝুঁটি ফুলিয়ে প্রবল বিক্রমে লড়ে চলেছে দূর দূরান্ত থেকে আসা তাগড়া সব মোরগ। হুড়া থেকে আদ্রা যাওয়ার পথে জোড়গোড়ার কাছে প্রতি বছর ৭ এবং ৮ ফাল্গুন এই লড়াইয়ের আসর বসে। এই সমস্ত ব্যাপারে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন, তাঁদের কাছে শিমুলতলার আখড়া মোরগ লড়াইয়ের ‘কলোসিয়াম’।
রাঢ়বঙ্গের জনপ্রিয় সাবেক বিনোদন মোরগের লড়াই। মকর সংক্রান্তির পরে বিভিন্ন মেলায় বসে যায় আসর। চাষির ঘরে ধান। আর হাতে থাকে টাকা আর অবসর দুই-ই। বাঁকুড়ার ঝিলিমিলি, পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি, ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ— মাঠে মাঠে বসে লড়াইয়ের আসর। তাতে গোটা রাঢ়ের মধ্যে গত ৫৮ বছর ধরে একেবারে প্রথমের সারিতে জাঁকিয়ে বসে রয়েছে শিমুলতলার আখড়া। জোড়গোড়া ষোলোআনা মেলা কমিটির সুশীল মান্ডি, সমীরণ মুর্মুরা বলছিলেন, ‘‘সেই ১৯৬১ নাগাদ শুরু। প্রতি বছর ভিড় বাড়ছে।’’
এ বারে আসর বসছে বুধ আর বৃহস্পতিবার। থিকথিক করছে মানুষ। লড়াই হচ্ছে কয়েক হাজার জোড়া মোরগের। মোরগ যাঁর, তাঁকে বলা হয় হাউসি। তবে শুধু মালিকের নয়, অনেক মোরগের ঘাড়েই থাকে গোটা গ্রামের নাম রাখার গুরুদায়িত্ব। প্রায় গাঁ-সুদ্ধ লোক সেই সমস্ত মোরগের সঙ্গে আখড়ায় চলে আসেন। সে হইহই কাণ্ড, রইরই ব্যাপার। কলকাতার রাজারহাট থেকে তিনটি মোরগ নিয়ে এসেছিলেন আসগর আলিরা। জানালেন, বাঁকুড়ার ঝিলিমিলির হাট থেকে সেগুলি কিনেছিলেন গত বছর। দাম সাড়ে চার থেকে সাড়ে ছ’হাজার টাকা।
মাঠে দেখা হল ব্রজেনচন্দ্র মাঝির সঙ্গে। আদ্রার কাছে দুয়ারিমহল গ্রামের ব্রজেনবাবু কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী। জানালেন, সেই ১৯৭৪ থেকে এই আখড়ায় তাঁর আসা। বলেন, ‘‘তিন বার আসতে পারিনি। আর তিন বার হেরে গিয়েছিলাম। তা ছাড়া আমার মোরগদের কখনও কেউ কাবু করতে পারেনি। এ বারেও আমার মোরগ এলাকার দু’টো আখড়ায় জিতে এসেছে।’’
ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ থেকে দু’টি মোরগ নিয়ে এসেছিলেন স্বপনকুমার রায়। বিসিসিএল-এর কর্মী স্বপনবাবু জানান, এই নিয়ে সাত বছর শিমুলতলায় আসা হয়ে গেল। এ বার দু’টি মোরগই জিতে তাঁর নাম রেখেছে।
কী হিসাবে লড়াইটা হয়? উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, বেশ কিছু দিন আগে থেকেই তাঁদের সঙ্গে এলাকার মোরগ-মালিকেরা যোগাযোগ করেন। তার মধ্যে থেকে বাছাই মোরগদের নিয়ে আসা হয় ময়দানে। বাইরে থেকে আসা মোরগদের জন্য থাকে খোলা চ্যালেঞ্জ। জিতলে পুরস্কার। এর বাইরেও প্রচুর লোকজন আসেন নিজের নিজের মোরগ নিয়ে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলে লড়াই। হিসেবও সহজ। যাঁর মোরগ জিতবে, ঘায়েল মোরগও তাঁর।
এই লড়াই রীতিমতো রক্তারক্তি কাণ্ড। মোরগের বাঁ পায়ে বেঁধে দেওয়া হয় বাঁকানো একটা ছুরি। তার নাম ‘কাইত’। আখড়াতেই ভাড়া পাওয়া যায়। অনেকেই বাক্সভর্তি তেমন ছুরি নিয়ে চলে আসেন। বাঁকুড়ার খাতড়ার বনতিল্লা থেকে যেমন এসেছেন হারাধন মাহাতো। পাঁচ বছর ধরে এই আখড়ায় তাঁর আসা-যাওয়া। সারা বছরের পেশা চাষবাস। এই সময়টায় ছুরির বাক্স নিয়ে ঘুরে বেড়ান আখড়া থেকে আখড়ায়। একটা কাইত বেঁধে মেলে ৫০ থেকে ১০০ টাকা। শিমুলতলায় এক দিনেই নয় নয় করে হাজার পাঁচ-সাত টাকা আয় হয়ে যায় বলে জানালেন।
আবার ঘায়েল মোরগের চোট সারাতেও বেশি ছোটাছুটি করতে হয় না। জনা পঞ্চাশ ‘চিকিৎসক’ হাজির থাকেন মাঠেই।
মাঠের একটি গাছের ডালে বিজ্ঞাপন টাঙিয়ে নীচে বসেছিলেন এক জন। কাপড়ে বড় বড় হরফে লেখা ‘মোরগ চিকিৎসা কেন্দ্র’। নাম বললেন, সুপ্তিরঞ্জন নন্দি। দাবি করলেন, কলকাতা থেকে রাঁচি পর্যন্ত তাঁর পসার। গাছের নীচে রাখা ওষুধ, ব্যান্ডেজ আর ইঞ্জেকশন। যেমন চোট, তেমন চিকিৎসা।
খরচ? ৫০ টাকা, ১০০ টাকা। রোগীর অবস্থা গুরুতর হলে কোনও কোনও ডাক্তারবাবু ২০০ টাকা পর্যন্ত ফি নিচ্ছিলেন। হাজার মোরগের ডানার ঝাপটানিতে লাল ধুলো ওড়ে শিমুলতলার মাঠে। ফুরোয় বুধবার। আজ, বৃহস্পতিবার সেখানে পুরস্কার বিতরণের পালা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy