Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪

টক্করে তৃণমূলের দুই ঘরের ছেলে

একজন তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে তৃণমূল ছেড়েছেন। অন্যজন তৃণমূল বিধায়ক বাবাকে দেখভালের জন্য মোটা বেতনের চাকরি ছেড়েছেন। প্রথম জনের লক্ষ্য, তৃণমূলের ভোট ভাঙিয়ে তৃণমূলকেই সবক শেখানো। দ্বিতীয় জন চাইছেন, সরকারের উন্নয়নের কথা বলে এই কেন্দ্র তৃণমূলেরই দখলে রাখতে।

(বাঁ দিক থেকে) কংগ্রেস প্রার্থী সুদীপ মুখোপাধ্যায় পাশে পেয়েছেন বিক্ষুদ্ধ তৃণমূল নেতা-কর্মীদের। পিছনে রয়েছে জোটসঙ্গী বামেদের-সমর্থন। তৃণমূলের প্রার্থী দিব্যজ্যোতিপ্রসাদ সিংহ দেও বাবার দেখানো পথেই প্রচার চালাচ্ছেন। ছবিগুলি তুলেছেন সুজিত মাহাতো।

(বাঁ দিক থেকে) কংগ্রেস প্রার্থী সুদীপ মুখোপাধ্যায় পাশে পেয়েছেন বিক্ষুদ্ধ তৃণমূল নেতা-কর্মীদের। পিছনে রয়েছে জোটসঙ্গী বামেদের-সমর্থন। তৃণমূলের প্রার্থী দিব্যজ্যোতিপ্রসাদ সিংহ দেও বাবার দেখানো পথেই প্রচার চালাচ্ছেন। ছবিগুলি তুলেছেন সুজিত মাহাতো।

প্রশান্ত পাল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৪৭
Share: Save:

একজন তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে তৃণমূল ছেড়েছেন।

অন্যজন তৃণমূল বিধায়ক বাবাকে দেখভালের জন্য মোটা বেতনের চাকরি ছেড়েছেন।

প্রথম জনের লক্ষ্য, তৃণমূলের ভোট ভাঙিয়ে তৃণমূলকেই সবক শেখানো।

দ্বিতীয় জন চাইছেন, সরকারের উন্নয়নের কথা বলে এই কেন্দ্র তৃণমূলেরই দখলে রাখতে।

প্রথম জন নিজেই তৃণমূলের হেঁশেল সামলেছেন দীর্ঘদিন। লড়াই তাঁর চেনা ময়দানে।

আর দ্বিতীয় জন ভোট ময়দানে আনকোরা। তবে রক্তে তাঁর রাজনীতি।

পুরুলিয়া বিধানসভা কেন্দ্রের লড়াই তাই এ বার মশলাদার হয়ে উঠেছে। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে এই কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবে দিব্যজ্যোতি প্রসাদ সিংহ দেওয়ের নাম শুনে অনেকেই চমকে উঠেছিলেন। তৃণমূলেরই অনেক নেতা-কর্মী বলে উঠেছিলেন— ‘‘এ কে?’’ ফোনাফুনি করতেই জানা যায়, উনি আর কেউ নন, এই কেন্দ্রের বিদায়ী বিধায়ক তথা পুরুলিয়ার পুরপ্রধান কে পি সিংহ দেওয়ের ছেলে। বাবার অসুস্থতার জন্য তিনি কিছুদিন আগেই কর্পোরেট জগতের চাকরি ছেলে বাড়ি ফিরেছেন। রাজনীতির উঠোনে আনকোরা হলেও দলের কর্মীরা যে তাঁকে সাদরে মেনে নিয়েছেন, মনোনয়নের দিনেই টের পেয়েছে পুরুলিয়া। কুলদেবী রাজরাজেশ্বরী দেবীর মন্দিরে পুজো দিয়ে পঞ্চকোট রাজবংশের নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধি যে দিন তাঁর মনোনয়ন জমা দিতে গেলেন, সেদিন তাঁর পিছনে ছিল হাজার মানুষের মিছিল।

কংগ্রেস তথা জোটের প্রার্থীও তৃণমূলের ঘরেরই ছেলে— সুদীপ মুখোপাধ্যায়। পুরুলিয়ার রাজনীতির হাঁড়ির খবর রাখেন। শহরের তো বটেই, দীর্ঘদিন যুব তৃণমূলের জেলা সভাপতির দায়িত্বভারও সামলেছেন। জেলা নেতৃত্বের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর একাংশের বিরুদ্ধে তিনি উপেক্ষার অভিযোগ সামনে এনে গত পুরভোটের আগে তৃণমূল ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দেন। তৃণমূলকে হারিয়ে কাউন্সিলরও হন। পুরনো দলের বিরুদ্ধে বিধানসভা ভোটেও কি তিনি সফল হবেন? প্রশ্নটা ঘুরছে তাঁর অনুগামীদের মধ্যে।

কারণ তাঁরা সামনে আনছেন, মাসখানেক আগে কেপি-র সঙ্গে কাউন্সিলরদের একাংশের বিরোধের প্রসঙ্গ। যদিও সেই বিক্ষুদ্ধ কাউন্সিলেরা তৃণমূল প্রার্থীর হয়ে প্রচারে নেমেছেন। এই কেন্দ্রের মানচিত্রে পুরুলিয়া পুরএলাকার পাশাপাশি পুরো পুরুলিয়া ২ ব্লক এবং পুরুলিয়া ১ ব্লকের দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে। এই এলাকায় তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের খবর কারও অজানা নয়।

পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল ব্যাপক সাফল্য পেলেও লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে আতসকাচ ফেললে দেখা যায়, এই কেন্দ্রে তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন ধরেছে। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে এই কেন্দ্রে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে কে পি ২৬,৪৮৭ ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। সে বার তাঁর প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫৩.৯৫ শতাংশ। কিন্তু লোকসভায় তৃণমূলের এই কেন্দ্রে ভোটপ্রাপ্তি নেমে আসে ৩৮.৮৬ শতাংশে। কংগ্রেস একক ভাবে পায় ২৪.১৩ শতাংশ, বামেরা ২২.২৩ শতাংশ। ওই দুই দলের মিলিত ভোটের থেকে বেশ পিছিয়ে তৃণমূলের ভোট।

দু’বছর আগের সেই অঙ্কই বাম-কংগ্রেস কর্মীদের আরও চাঙ্গা করে তুলেছে। তাঁদের দাবি, এ বার বিক্ষুদ্ধ বামপন্থীরাও পুরনো শিবিরে ফিরছেন। তাই এখানে জয়ের ব্যাপারে তাঁরা আশাবাদী।

যদিও তৃণমূল শিবিরের পাল্টা দাবি, দিব্যজ্যোতি রাজনীতিতে নবাগত হলেও রাজনীতির জগতে তাঁদের পরিবারের একটা আলাদা পরিচিতি আছে। সেই সঙ্গে বর্যীয়ান তৃণমূল নেতা হিসেবে কেপি-র স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রয়েছে। সে সবই তাঁর ছেলে দিব্যজ্যোতির প্লাস পয়েন্ট। সেই সঙ্গে শিক্ষিত, ঝকঝকে, কম বয়েসি হিসেবে তরুণ প্রজন্মের কাছেও তাঁর আলাদা আবেদন রয়েছে বলে তৃণমূল কর্মীদের অভিমত।

আবার রাজনীতি নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা জানাচ্ছেন, পুরুলিয়া শহর কংগ্রেসের মধ্যে চোরাস্রোত বইছে। কংগ্রেস প্রার্থীর হয়ে শহরে ও মফস্‌সলের বামফ্রন্টের কর্মীরা আসরে নামলেও দেখা মেলেনি পুরুলিয়ার কংগ্রেস নেতা বিভাস দাস, রথীন্দ্রনাথ মাহাতোদের। এ বার সুদীপের সঙ্গেই এই কেন্দ্রে টিকিটের দাবিদার ছিলেন বিভাসবাবুও। দল সূত্রে খবর, দু’জনের নামই দিল্লি পর্যন্ত গিয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেস সুদীপকে প্রার্থী করায় তা মেনে নিতে পারেননি বিভাসবাবু ও তাঁর অনুগামীরা। তাঁদের ক্ষোভ, এখনও যাঁর গা থেকে তৃণমূলের গন্ধ মোছেনি, তাঁকে কী করে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে মেনে নেওয়া যায়? এই অসন্তোষ তৃণমূলের পালে হাওয়া দিলেও দিতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।

সুদীপ তাই শুধু বাম ও কংগ্রেসের ভোটই নয়, তৃণমূলের ভোট ভাঙানোরও চেষ্টায় নেমে পড়েছেন। প্রচারে বলছেন, ‘‘পরিবর্তনের পরে দেখলাম দলের একাংশ তোলাবাজিতে ঢুকে পড়ল। অথচ নেতৃত্বের মুখে কুলুপ। পরিবর্তনের আগে যাঁরা কাঁধে দলের পতাকা নিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই আজ দলে ব্রাত্য।’’ বিধায়কের বিরুদ্ধে জল-সহ নানা সমস্যা মেটাতে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে মুখরক্ষা করতে ছেলেকে ভোটে ঠেলে দিয়েছেন বলে সুদীপ অভিযোগ তুলেছেন।

অসুস্থতার জন্য ছেলের প্রচারে বাবা নামতে পারছেন না। তবে বিরোধীদের মুখ বন্ধ করতে বলছেন, ‘‘আমি নিজের এলাকায় যা করেছি এবং আমাদের সরকার যা করছে তা তো লুকোনো নেই। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্রীড়া, জল-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যা উন্নয়ন হয়েছে তা উল্লেখ করে একটি রিপোর্ট কার্ডও আমি মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছি।’’ আর দিব্যজ্যোতি শুধু বলছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুরুলিয়ার চেহারাটা কী ভাবে বদলে দিয়েছেন সবাই জানেন। আরও উন্নয়নের জন্যই মানুষ তৃণমূলকে ভোটটা দেবেন।’’

বিজেপির প্রার্থী নগেন্দ্রনাথ ওঝা দাবি করছেন, ‘‘এলাকায় ঘুরে টের পাচ্ছি, বিজেপি লড়াই দেবে।’’ কিন্তু ভাঙাচোরা সংগঠন নিয়ে লোকসভার ভোটও (১০.৫১%) বিজেপি টানতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে দলের অনেক কর্মীই।

অতীতে এই কেন্দ্র তারাপদ রায়-সুকুমার রায় পিতা-পুত্র উভয়কেই বিধানসভায় প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দিয়েছে। পাশের হুড়া কেন্দ্র থেকেও বিধানসভায় প্রতিনিধিত্ব করেছেন আর এক পিতা-পুত্র দিব্যজ্যোতির ঠাকুরদা অজিতপ্রসাদ সিংহ দেও ও জেঠু রাজরাজেশ্বরী প্রসাদ সিংহ দেও। জেলায় পিতা-পুত্রের বিধানসভায় প্রতিনিধিত্ব করার একাধিক নজির রয়েছে। ফের সেই ইতিহাসে নতুন জুটির কথা লেখা হবে, না কি বিদ্রোহী সুদীপকেই হাসবেন, শুরু তারই অপেক্ষা।

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy