প্রত্যয়ী: ময়দানে শীলা বাগদি। ছবি: সুজিত মাহাতো
মাঝ মাঠ থেকে চিৎকার— ‘‘ঝর্না বল ছাড়...। তুই ডিফেন্সের প্লেয়ার। বল ক্লিয়ার করতে দেরি করছিস কেন?’’ খানিক দৌড়ে ফের হাঁক— ‘‘কী করছিস সোনামণি? বাঁ দিকে বলটা বাড়ালেই সোজা গোলে।’’
পুরুলিয়ার জয়পুর কলেজের মাঠ দাপাচ্ছেন এক দল মেয়ে। বাতাসে আগামনী সুর, চারপাশে মাথা দোলাচ্ছে কাশ। তাদের বয়সি অনেকেই শহরে গিয়ে কেনাকাটায় ব্যস্ত। কিন্তু সে সবের যেন ভ্রূক্ষেপ নেই জয়পুরের মহিলা ফুটবল দলের। সামনেই যে ম্যাচ! তাই শেষ মুহূর্তে সবাইকে ভুলগুলো ধরাতে ব্যস্ত দলের ‘ক্যাপ্টেন’ শিলা বাগদি। তাঁর ডাকেই তো কত মেয়ে ফুটবল পেটাতে প্রতিদিন জঙ্গলের পথ পেরিয়ে সাইকেলে ছুটে আসছেন কলেজ মাঠে।
জয়পুরের খেদাটাঁড় গ্রামের শিলার ছোট থেকেই খেলনাবাটি খেলায় মন ছিল না। বরং পাড়ায় ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল পেটানোই পছন্দ ছিল তাঁর। কে তাতে চোখ কোঁচকাচ্ছেন আমল দেননি বছর আঠারোর এই তরুণী। ফলও ফলেছে।
পুলিশের হয়ে জয়পুরের মেয়েদের ফুটবল দল তৈরি করতে গ্রামে গ্রামে খোঁজ শুরু করেন ফুটবলের প্রশিক্ষক জগন্নাথ বাগদি। শিলা তাঁর নজরে আগে থেকেই ছিলেন। তিনি শিলাকে দল তৈরির জন্য মেয়ে জোগাড় করতে বলেন। শিলার কথায়, ‘‘প্রথমে গ্রামের মেয়েদের বললাম, ‘মাঠে আয়’। কেউ বলল, ‘ঘর থেকে ছাড়বে না’। কেউ বলল, ‘ঘরে অভাব’। তাদের বোঝালাম। বাড়ির লোকেদের বোঝালাম। বললাম, ঘরে বসে থাকলে কি অভাব ঘুচবে? মাঠে চল।’’
অভাব শিলার ঘরেও। তাঁর বাবা মতিলাল বাগদি ঝাড়খণ্ডের একটি মেসে রান্নার কাজ করেন। তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে সংসার চালাতে হিমসিম খান মা বড়কি বাগদি। সে সবে শিলা অবশ্য দমেননি।
প্রথমবারেই রাজ্য পুলিশ আয়োজিত জঙ্গলমহল কাপে শিলার নেতৃত্বে জয়পুর মহিলা দল চ্যাম্পিয়ন। জগন্নাথবাবুর কথায়, ‘‘ওই জয়ে মেয়েদের আত্মবিশ্বাস যেমন বাড়ে, তেমনই গ্রামের লোকের মানসিকতাও বদলায়। কিন্তু সাফল্য ধরে রাখতে আরও মেয়ের দরকার ছিল। শিলা গ্রামে গ্রামে ঘুরে মেয়েদের সঙ্কোচ কাটিয়ে মাঠে টেনে আনতে শুরু করে।’’
সেই শুরু। এখন জয়পুরের মহিলাদের তিনটি দল তৈরি। জঙ্গলমহল কাপে টানা চার বার চ্যাম্পিয়ন, কন্যাশ্রী কাপে জোড়া চ্যাম্পিয়নের পালক এখন
তাদের মুকুটে।
জগন্নাথবাবুর কথায়, ‘‘শিলাকে দেখে এখন প্রচুর মেয়ে মাঠে আসছে। প্রায় পঞ্চাশ জন মেয়ে নিয়মিত ফুটবল অনুশীলন করছে। ক’বছর আগেও যা ভাবা যেত না।’’ তিনি জানান, মাঠের টানে সাত সকালেই টানা ছয়-সাত কিলোমিটার সাইকেল চালিয়েও অনেকে আসছেন।
ব্যক্তিগত স্তরেও স্ট্রাইকার পজ়িশনে খেলা শিলা অনূর্ধ্ব ১৯ বাংলা দলে জায়গা করে নিয়েছেন। রয়েছেন কুসুমটিকরির সোনামণি মাহাতোও। অনূর্ধ্ব ১৭ বাংলা দলে জায়গা মিলেছে গুঞ্জা গ্রামের ঝর্না মাহাতো, খেদাটাঁড়ের মমতা বাগদির। ঝর্না, মমতারা বলে, ‘‘শিলা যে ভাবে উৎসাহ দেয়, মাঠে নামার আগেই আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়ে যায়।’’
মহামেডান স্পোর্টিং ও অনূর্ধ্ব ১৭ জাতীয় দলে খেলা প্রাক্তন পাহাড়ি ফুটবলার লাকপা শেরপা মাঝে মধ্যে শিলাদের প্রশিক্ষণ দেন। তাঁর কথায়, ‘‘ওই এলাকার মেয়েদের কাছে শিলা ‘আইকন’। অনেক মেয়ের মধ্যে প্রতিভা রয়েছে। খুঁজে বার করে ভাল প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।’’
২০১৭ সালে যুব বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রচারে ইউনিসেফের হয়ে শ্রীলঙ্কা ঘুরে এসেছেন শিলা। জয়পুরের আরবিবি হাইস্কুলের একাদশ শ্রেণির এই ছাত্রীর কথায়, ‘‘হাডুডু কিংবা চু-কিত-কিত ছেড়ে এত মেয়ে ফুটবল খেলছে দেখে ভাল লাগে। এটাও কম লড়াই নাকি?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy