ক্ষোভ ছিলই। নিহত ঠিকাশ্রমিক প্রশান্ত দেওঘরিয়ার মৃতদেহ বাঁকুড়ায় ফিরতেই বিক্ষোভে নামল জনতা।
গাড়িতে কয়েক ফোঁটা রঙের ছিটে লেগে গিয়েছিল। আর সেই অপরাধে রঙের শ্রমিক প্রশান্তকে বাঁশ দিয়ে আঘাত করে খুন করার অভিযোগ উঠেছে বাঁকুড়া মেডিক্যালের শিক্ষক-চিকিৎসক দেবল সোরেনের বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত চিকিৎসককে পুলিশ এখনও গ্রেফতার না করতে পারায় নিহতের আত্মীয়-পরিজন এবং এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ ছড়াচ্ছিল। রবিবার সন্ধ্যায় প্রশান্তের দেহ কলকাতা থেকে বাঁকুড়ায় আসে। তাঁর দেহ বাঁকুড়া সদর থানার সামনে রেখে শুরু হয় বিক্ষোভ। থানার সামনের রাস্তা অবরোধ করা হয়। বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দেন— ‘দোষী ডাক্তারের চরম সাজা চাই’।
প্রশান্তর দেহ নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে এসেছিলেন শতাধিক মানুষজন। তাঁরা থানা চত্বরের ভিতরে ঢুকে যায়। সেখান থেকেই পুলিশ কেন ওই ডাক্তারকে ঘটনার তিনদিন পরেও গ্রেফতার করতে পারেনি, তা নিয়ো ক্ষোভ-বিক্ষোভ শুরু হয়। নিহতের বৌদি মণিকা দেওঘরিয়া স্থানীয় জুনবেদিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের সিপিএম সদস্যা। তিনি থানা চত্বরে অভিযোগ তোলেন, একটা মানুষকে একজন ডাক্তার বাঁশ দিয়ে মেরে ফেলল। অথচ পুলিশ তাঁকে ধরছে না। কারণ আমরা গরিব।’’ হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে দেখাতে জনতা বারবার স্লোগান দিচ্ছিল। পুলিশ আধিকারিকরা তাঁদের আশ্বাস্থ করার পরে জনতা সরে যায়। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে অবরোধে কিছুক্ষণ ওই এলাকায় যান চলাচল ব্যাহত হয়।
পুলিশ সূত্রে খবর, অভিযুক্ত ওই ডাক্তার পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা ২ ব্লকের ঢেকিনেজা গ্রামের বাসিন্দা। অভিযোগ ওঠার পর থেকেই ওই ডাক্তার এলাকায় নেই। যদিও ঘটনার তদন্তকারীরা ওই চিকিৎসকের বাড়িতে যাননি বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। আবার মেদিনীপুর জেলা পুলিশ সূত্রে খবর, বাঁকুড়া সদর থানা থেকে তাদেরও ওই চিকিৎসকের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে বলা হয়নি। তাই এই মামলায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে। রবিবারই বাঁকুড়া জেলা পুলিশ সুপারের দায়িত্ব নিয়েছেন সুখেন্দু হিরা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ঘটনাটি শুনেছি। তদন্তের কী পরিস্থিতি বিশদে খোঁজ নেব।”
বৃহস্পতিবার বাঁকুড়া মেডিক্যালের আবাসনে বিদ্যুতের খুঁটিতে রং করছিলেন কয়েকজন শ্রমিক। সন্ধ্যার দিকে ওই রঙের কয়েক ফোঁটা ছিটকে দেবলবাবুর গাড়িতে পড়ে। এর জেরে ক্ষেপে উঠে দেবলবাবু প্রশান্ত দেওঘরিয়া (৪০) নামের ওই শ্রমিকের মাথায় বাঁশ দিয়ে আঘাত করেন বলে অভিযোগ। শনিবার কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে মৃত্যু হয় বাঁকুড়ার কুলপোতা গ্রামের ওই শ্রমিকের। ইতিমধ্যেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও নিহতের পরিবার থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন।
এ দিকে, এক শ্রমিককে খুনে হাসপাতালের শিক্ষক-চিকিৎসকের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় তাজ্জব অনেকেই। বাঁকুড়া শহর তো বটেই, রবিবার দিনভর জেলার বিভিন্ন গাঁয়ে-গঞ্জে এই ঘটনা নিয়েই লোকজনকে আলোচনা করতে দেখা গিয়েছে। ওই ডাক্তারের নাগাল পুলিশ কেন পাচ্ছে না, তা নিয়েও জল্পনা চলে।
পেশায় স্কুল শিক্ষক বাঁকুড়ার কাটজুড়িডাঙার বাসিন্দা শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় বলেন, “ডাক্তাররা অনেক সংযমি হন বলেই জানতাম। কিন্তু এই ঘটনাটি নানা প্রশ্ন তুলে দিল।” বাঁকুড়ার কেশিয়াকোলের গৃহবধূ অর্চনা অধিকারীর কথায়, “খবরের কাগজে ঘটনাটি পড়ে আমরা সবাই অবাক হয়ে গিয়েছি!’’ বাঁকুড়ার অরবিন্দনগরের বাসিন্দা সঙ্গীত শিল্পী জয়দীপ মুখোপাধ্যায় বলেন, “চিকিৎসকেরা সমাজের উঁচুস্তরের মানুষ। এই ঘটনাটি সত্যি হলে নৃশংসতার নজির গড়ল।”
কম বিস্মিত নন ওই চিকিৎসকের সহকর্মীরাও। বাঁকুড়া মেডিক্যালের এক চিকিৎসক বলছেন, “দীর্ঘদিন ধরেই কাছ থেকে দেবলকে দেখছি। কম কথার মানুষ। আমরা ওঁকে ঠান্ডা মাথার লোক হিসেবেই জানতাম। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ওঠায় প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাইনি।’’ তৃণমূল প্রভাবিত চিকিৎসকদের সংগঠন প্রোগ্রেসিভ ডক্টরর্স অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য যুগ্ম সম্পাদক জয়মাল্য ঘর এ দিন বলেন, “আইন এই ঘটনার যথাযথ বিচার করুক। ওই শ্রমিকের পরিবারের কথা ভেবে খারাপ লাগছে।” প্রশান্তর মামা কার্তিক অধিকারীর আক্ষেপ, ‘‘ওই ডাক্তারের গাড়িতে লাগা রং চাইলেই ধুয়ে সাফ করে দেওয়া যাবে। কিন্তু একমাত্র রোজগেরে প্রশান্তকে হারিয়ে তাঁর পরিবারের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল তা কি কোনও দিন মিটবে?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy