Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Painting

রং যেন ভাবনার বিকাশ ঘটায়, পথের ধারে আঁকার স্কুল

এই নিষ্ঠা ও ভালবাসাকে সঙ্গী করেই এক অনন্য শিক্ষাকর্মে ব্রতী হয়েছেন শান্তিনিকেতন কলাভবনের এই প্রাক্তন ছাত্র।

শিক্ষক: আঁকা শেখাচ্ছেন অনুপ গোপী। নিজস্ব চিত্র

শিক্ষক: আঁকা শেখাচ্ছেন অনুপ গোপী। নিজস্ব চিত্র

সৌরভ চক্রবর্তী
শান্তিনিকেতন শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২০ ০৩:৪৭
Share: Save:

রাস্তার ধারে খোলা মাঠে গাছের ছায়ায় হেমন্তের মিঠে রোদ গায়ে মেখে চলে সৃষ্টি সুখের উল্লাস। রং, কাগজ সবটাই বয়ে নিয়ে আসেন আঁকার শিক্ষক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে ভাবে চেয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে শিশুরা প্রথাগত শিক্ষার বাইরে মনের খুশি আর খেয়ালে নিজেদের শিল্প প্রতিভার বিকাশ ঘটাক, এই রং-তুলির পাঠশালা যেন তারই প্রকাশ। প্রথাগত স্কুল শেষে ছেলে-মেয়েরা দলে দলে ছুটে আসে রং দিয়ে নিজেদের ভাবনাকে মেলে ধরতে। এই আঁকার পাঠশালার অন্যতম কারিগর অনুপ গোপী। আদতে কেরালার বাসিন্দা। এ বছরই রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের হাত থেকে ললিতকলা পুরস্কার নিয়েছেন। কিন্তু গোয়ালপাড়ার সুজন মুর্মু, নীরু মুর্মুদের কাছে রামনাথ কোবিন্দ বা ললিতকলা পুরস্কার অচেনা। তাঁরা শুধু চেনেন তাঁদের প্রিয় অনুপদাকে।

অনুপ নিজে বিশ্বাস করেন, ‘‘প্রকৃত শিক্ষক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া অত্যন্ত কঠিন। নিরলস অধ্যাবসায়, কাজের প্রতি প্রবল নিষ্ঠা এবং শিক্ষার্থীর প্রতি অনিঃশেষ শ্রদ্ধা ও ভালবাসার মিশেলেই তৈরি হয় প্রকৃত শিক্ষকের কাঠামো।’’ এই নিষ্ঠা ও ভালবাসাকে সঙ্গী করেই এক অনন্য শিক্ষাকর্মে ব্রতী হয়েছেন শান্তিনিকেতন কলাভবনের এই প্রাক্তন ছাত্র। অনুপবাবুর গবেষণার বিষয়ই ছিল আদিবাসী জনজীবন। সেই কাজের উদ্দেশ্যে প্রায়ই তিনি আঁকতে আসতেন গোয়ালপাড়া সংলগ্ন আদিবাসী পল্লিগুলিতে। সেখানে যাতায়াতের ফলেই তিনি অনুভব করেন, সাঁওতাল জনজীবন থেকে যখন তিনি নিজের কাজের রসদ সংগ্রহ করছেন, তখন সেই জনজাতির প্রতি তাঁরও কিছু দায়বদ্ধতা থেকেই যায়। সেই তাড়নাতেই গোয়ালপাড়ায় গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নিয়মিত ছবি আঁকার পাঠশালা চালিয়ে আসছেন অনুপ গোপী। স্থানীয় প্রায় ২০-২৫ জন আদিবাসী শিশুকে নিয়ে সম্পূর্ণ অবৈতনিক পাঠশালায় তিনি ছাত্রদের কাছে ‘আঁকার গুরুমশাই’।

চার দেওয়ালের শিক্ষার বাইরে উন্মুক্ত পরিবেশে শেখার আনন্দকে ছড়িয়ে দিয়েই চলছে পাঠশালা। শিশুদের সংখ্যা ও ছবি আঁকার উৎসাহও বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার পরিসর থাকলেও সাংস্কৃতিক চর্চা বা তাকে ভিত্তি করে ভিন্ন ধারার যে শিক্ষার কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও চাইতেন তা নিয়মিতভাবে নেই বললেই চলে। তাই, গয়েসপুকুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী মিনতি মুর্মু, মকরমপুরের চতুর্থ শ্রেণির শুভজিৎ মুর্মুরা স্কুল শেষ হতেই পৌঁছে যায় তাদের প্রিয় ‘আকার গুরুমশাই’য়ের পাঠশালায়। প্রয়োজনে দুঃস্থ শিশুদের আঁকার খাতা বা মোম রং সরবরাহও করেন তিনি। তবে শুধু আঁকার পাঠ দেওয়াই অনুপবাবুর একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, এর সঙ্গে জীবনশৈলী, সুস্বাস্থ্য, পরিবেশ সচেতনতা সহ জীবনচর্যার প্রাথমিক পাঠ প্রদানের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টাও তাঁর কাজের অন্যতম অঙ্গ।

ভাষাগত দূরত্ব, সংস্কৃতিগত দূরত্বের বেড়াজাল অতিক্রম করে অনুপবাবুর এই প্রচেষ্টা এখন গ্রামের শিশুদের শিক্ষার এক নতুন পরিসর উন্মুক্ত করছে। অনুপবাবুর কথায়, “আমি যা পারি, যেটুকু পারি, সেটুকুই দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু পরিবর্তে যে ভালবাসা, যে উজ্জ্বলতা পাচ্ছি প্রত্যেক শিশুর মুখে, তা মূল্যের বিনিময়ে বিচার করা সম্ভব নয়।”

অন্য বিষয়গুলি:

Painting Arts and Culture Drawing class
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy