Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

‘নোটগুলো একটু রেখে দেবেন?’, মিনতি প্রৌঢ়ার

হাতের মুঠোয় যত্ন করে ধরা ছ’টি ৫০০ টাকার নোট। সেটাই তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে প্রৌঢ়া বলছেন, ‘‘একটা আবদার করব, রাখবেন? টাকাগুলো আপনার কাছে থাক।’’

দয়াল সেনগুপ্ত
খয়রাশোল শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৬ ০০:৫৯
Share: Save:

হাতের মুঠোয় যত্ন করে ধরা ছ’টি ৫০০ টাকার নোট। সেটাই তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে প্রৌঢ়া বলছেন, ‘‘একটা আবদার করব, রাখবেন? টাকাগুলো আপনার কাছে থাক।’’

শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন ব্যাঙ্কের ওই শাখা ম্যানেজার। মহিলা বলে চলেছেন, ‘‘যখন টাকা আসবে তখন ১০০ টাকার নোটে আমায় ফেরত দেবেন। চুরি করা টাকা নয়, খুব কষ্ট করে সংসার খরচ বাঁচিয়ে জমিয়েছিলাম। আমার তো ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট নেই। এখন আপনি-ই আমার একমাত্র ভরসা।’’ ভদ্রলোক তিন দশকের বেশি ব্যাঙ্কে কর্মরত। কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর এই প্রথম। না, করতে পারেননি ওই প্রৌঢ়াকে। টাকাটা নিয়ে মানিব্যাগে রেখে দেন। সময় হলেই ফিরিয়ে দেবেন ঠিক করেছেন।

গত শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টায় ঘটেছিল ঘটনাটি। নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের জেরে বৃহস্পতিবার থেকে রবি, টানা চার দিন অন্যান্য ব্যাঙ্কের মতো খয়রাশোল ব্লকের ওই শাখাতেও ব্যাপক ভিড়। হবে না-ই বা কেন, এই শাখাটি ছাড়া আর কোনও ব্যাঙ্ক নেই এলাকায়। এলাকার প্রায় কুড়ি হাজার গ্রাহক ওই ব্যাঙ্কের উপরেই নির্ভরশীল। গত চার দিনে গড়ে সাড়ে ছ’শো গ্রাহক সেখানে লাইন দিয়ে বাতিল টাকা জমা দিয়েছেন। ইতিমধ্যেই জমা পড়া টাকার অঙ্ক সাড়ে ৩ কোটি ছাড়িয়েছে। সিবিএস (‌কোর ব্যাঙ্কিং সিস্টেম) চালু হওয়ার পরে সব হিসাব মেশিনে আপডেট করে তবেই বাড়ি আসার ছাড় পাচ্ছেন ব্যাঙ্কের কর্মীরা। ফিরতে ফিরতে সেই রাত ১০টা। শুধু ওই শাখায় নয়, কমবেশি এমন ছবি দেশের প্রায় সব ব্যাঙ্কেরই। যেখানে দিনরাত এক করে পরিস্থিতি সামাল দিতে লড়ে যাচ্ছেন কর্মীরা।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাঙ্কের ওই শাখা ম্যানেজার বললেন, ‘‘সে দিনও ব্যাঙ্কের শার্টার নামিয়েছিলাম অনেক ক্ষণ। কিন্তু ভিতরে লাইট জ্বালিয়ে কাজ চলছিল তখনও। ছিলাম আমি আর আমার দুই ক্যাশিয়ার। জানালার ফাঁক দিয়ে লাইট বের হতে দেখে আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েই হাত বাড়িয়েছিলেন ওই প্রৌঢ়া। ভেবেছিলেন হয়তো, কাউকে না জানিয়ে শুধু ব্যঙ্ককর্মীর কাছে-ই এমন আবেদন করা যায়!’’

জেলার বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকার ব্যাঙ্কগুলির ম্যানেজারদের সঙ্গে কথা বলা জানা গিয়েছে, এখনও পর্যন্ত যে অ্যাকাউন্টগুলিতে টাকা জমা পড়েছে, তাঁদের সিংহভাগই গরিব মানুষ। জমা দেওয়া টাকার অঙ্ক সীমিত থেকেছে ১০,২০,৩০ হাজারের মধ্যেই। কিন্তু টাকার জোগান না থাকায় বহু ব্যাঙ্কই টাকা দিতে পারেনি। খয়রাশোলের ওই ব্যাঙ্কেই যেমন, শনিবার সন্ধ্যায় টাকা এসেছিল। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় তা অনেক কম। ফের টাকা আসার কথা মঙ্গলবার। বুধবার থেকে টাকা জমা নেওয়ার পাশাপাশি টাকা ফেরত দেওয়ার কাজও শুরু হবে বলে আশা ওই ম্যানেজারের।

ঘটনা হল, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজারহাট বা দৈনন্দিন কাজের জন্যই মানুষের টাকার প্রয়োজন। সিউড়ি এলাকার এক ব্যাঙ্কের কর্মী বলছেন, ‘‘ম্যানেজার স্যারের কাছে রোজ ফোন আসছে। কেউ অনুরোধ করছেন, ‘বাবু অমুক দোকানে ফোন করে একটু বলুন না, বুধবার টাকা পেয়ে যাব। আমাকে যেন জিনিস বিক্রি করে। আপনি বললে, ঠিক মানবে’। তো কেউ আমাকেই সরাসরি বলছেন, ‘কয়েকশো টাকা থাকলে দিন না। বুধবার টাকা পেয়ে প্রথমেই আপনার টাকাটা শোধ করে দেব।’’

টাকার জোগানটা ভাল হলে দুর্ভোগ অনেক কম হতো বলেই মত ব্যাঙ্কের আধিকারিকদের। যদিও তাঁদের বক্তব্য, ভালর জন্যই হয়তো সরকারের এমন সিদ্ধান্ত। যা মেনেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কও। কিন্তু এমন এক পরিস্থিতি, তাঁদের মতো সকল ব্যাঙ্ককর্মী-আধিকারিকদের কাছেই একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

খয়রাশোলের ওই শাখা ম্যানেজার বলছেন, ‘‘কয়েক বছর ধরে এখানে থাকার সুবাদে এলাকার মানুষের সঙ্গে ঘরোয়া সম্পর্ক হয়ে যায়। তাই হয়তো মানুষ, তাঁদের অসুবিধার কথা এ ভাবে বলছেন।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Old woman Old currency
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE