Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

নোট বাতিলে কাত গরুর হাট

সকাল থেকে একজোড়া গরু নিয়ে অপেক্ষাই সার। দুপুর গড়ালেও খদ্দের না জোটায় গরু জোড়া নিয়ে চুপচাপ হাট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন পুরুলিয়া ২ ব্লকের আড়িতা গ্রামের বাসিন্দা কালু আনসারি।

অন্য সময়ে জমজমাট থাকে। কিন্তু বড় নোট বাতিল হওয়ায় ছবিটাই বদলে গিয়েছে। বৃহস্পতিবার ফাঁকাই থাকল কাশীপুরের গবাদি পশুর হাট। ছবিটি তুলেছেন প্রদীপ মাহাতো।

অন্য সময়ে জমজমাট থাকে। কিন্তু বড় নোট বাতিল হওয়ায় ছবিটাই বদলে গিয়েছে। বৃহস্পতিবার ফাঁকাই থাকল কাশীপুরের গবাদি পশুর হাট। ছবিটি তুলেছেন প্রদীপ মাহাতো।

নিজস্ব সংবাদদাতা
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৪২
Share: Save:

সকাল থেকে একজোড়া গরু নিয়ে অপেক্ষাই সার। দুপুর গড়ালেও খদ্দের না জোটায় গরু জোড়া নিয়ে চুপচাপ হাট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন পুরুলিয়া ২ ব্লকের আড়িতা গ্রামের বাসিন্দা কালু আনসারি। শুকনো মুখে হাট ছাড়ার আগে কালুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘নাহ্‌, আজও বিক্রি হল না।’’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গরুগুলির গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বেরিয়ে গেলেন তিনি। পিছনে পড়ে রইল কাশীপুরের হাট।

পাঁচশো, হাজার টাকা নোট অচলের ধাক্কায় তাঁর মতো অনেকেই বৃহস্পতিবারের এই সাপ্তাহিক হাট থেকে গরু বা কাড়া বিক্রি করতে না পেরে ফিরে গিয়েছেন। কাউকে মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাড় করতে হবে, কাউকে ছেলের চিকিৎসার টাকা, কাউকে শোধ দিতে হবে চাষের জন্য ধার করা টাকা। সকাল থেকে হাটে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পরে সকলেরই প্রতিক্রিয়া, হাট জমলই না।

পঞ্চকোট রাজবংশের শেষ রাজধানী কাশীপুরের এই সাপ্তাহিক গবাদি পশুর হাটটি দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম বড় হাট। জেলার ইতিহাস গবেষক দিলীপকুমার গোস্বামীর কথায়, ‘‘১৯১২ সালে পঞ্চকোটের তৎকালীন মহারাজা জ্যোতিপ্রসাদ সিংহ দেও বাঁকুড়ার জনৈক মতিলালবাবু নামে এক ব্যক্তির পরামর্শে এই হাটের সূচনা করেছিলেন। রাজা ঘোষণা করেছিলেন, যে সমস্ত জিনিসপত্র এই হাটে বিক্রির জন্য মানুষজন নিয়ে আসবেন দিনের শেষে তা বিক্রি না হলে রাজা নিজে তা কিনে নেবেন। এই ঘোষণার পরে অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠল এই হাট। শতবর্ষ অতিক্রম করে এই হাট আজও এলাকার অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক ভিত্তি। অনেক দূরদূরান্তের মানুষজন বিশেষ করে চাষিরা বৃহস্পতিবারের এই সাপ্তাহিক হাটে গবাদি পশু কেনাবেচা করেন।

চাষের মরসুম শেষ হওয়ার পরে অনেকেই তাঁদের গবাদি পশু এই হাটে বিক্রি করেন। অনেকেই আছেন, যাঁরা এই হাটে গরু-কাড়া কিনে অন্য হাটে বিক্রি করে কিছু টাকা লাভ করেন। হাট পরিচালন কমিটির সদস্য বাবু করের কথায়, ‘‘মাঠ থেকে ধান উঠে যাওয়ার পরে বা কালীপুজো পার হয়ে যাওয়ার পরে এ সময় হাটে পা ফেলার জায়গা থাকে না। কিন্তু এ বার বড় নোট বাতিল হওয়ার পরে ছবিটাই পাল্টে গিয়েছে। বড় নোট বাতিল হওয়ায় লেনদেন কার্যত হয়নি।’’ পুরুলিয়া ২ ব্লকের কুসটুকা গ্রাম থেকে দু’জোড়া গরু নিয়ে বুধবার দুপুরে হাটে এসেছিলেন জয়দীশ আনসারি। গত সপ্তাহেও হাটে এসে গরু বিক্রি না করতে পেরে খালি হাতে তাঁকে ফিরতে হয়েছিল। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘এতটা পথ হেঁটে হাটে এসে ভোর থেকে গরু নিয়ে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। যাঁরাই কিনতে এলেন সবাই পকেট থেকে বাতিল হয়ে যাওয়া পাঁচশো, হাজারের নোট বের করছিলেন। টাকার খুব প্রয়োজন বলে দাম কমিয়েও দিয়েছিলাম। কিন্তু কারও কাছে নতুন টাকা পেলাম না।’’

পাড়া থানার হরিহরপুর গ্রাম থেকে এসেছিলেন শেখ সাবির। তাঁর মেয়ের বিয়ে ঠিক হচ্ছে। এ সময় টাকার বড় প্রয়োজন। তিনি দুটো গরু এনেছিলেন। ৩৫ হাজার টাকা দাম রেখেছিলেন। তাঁরও আক্ষেপ, ‘‘খদ্দের জুটল না। সকলেই সেই পুরনো নোট দিতে চায়। ওই নোট নিয়ে কী করব? বাজারে তো চলবে না।’’ হাটে আসা ক্রেতাদেরও সমান আক্ষেপ। টাকা নিয়ে ঘুরেও তাঁরা বাতিল নোট থাকায় গরু-কাড়া কিছুই কিনতে পারলেন না। সবারই বিস্ময়— ‘‘এমন ফাঁকা হাট কখনও দেখা যায়নি।’’

একই অভিজ্ঞতা হাটে যাঁরা গরু বাঁধার দড়ি (পাঘা), চা-তেলেভাজা-মিষ্টির দোকান দেন সেই ব্যবসায়ীদেরও। দড়ি বিক্রেতা সমীর মোদকের কথায়, ‘‘সকাল থেকে কিছুই বিক্রি হয়নি। কখনও এমন হয়নি।’’ চা-তেলেভাজার দোকানদার কার্তিক কর্মকারের কথায়, ‘‘পরপর দু’টো সপ্তাহ এই হাটে ব্যবসা মার খেল। কতদিন এমন চলবে কে জানে।’’

হাট পরিচালনা কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, সাধারণত এই সাপ্তাহিক হাটে একদিনে ৭০-৮০ লক্ষ টাকার বিকিকিনি হয়। বড় নোট বাতিলের ধাক্কায় সেই বেচাকেনা নেমেছে কমবেশি ১০ লক্ষ টাকায়।’’ কমিটির সদস্য গৌতম চৌধুরী বলছিলেন, ‘‘পঞ্চায়েত সমিতির কাছ থেকে আমরা বার্ষিক ২৩ লক্ষ টাকায় হাটটি নিলামে নিয়েছি। মানুষজনের বেচাকেনার পরে সামান্য মাশুলই আমাদের রোজগার। এই অবস্থা চললে আমাদের বড় অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Cow market demonetisation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy