জলের অপেক্ষায়। সিউড়িতে সোমবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
জলেই শুরু। জলেই শেষ!
লোকসভা ভোটের আগে তড়িঘড়ি যার উদ্বোধন করে দিয়েছিল জেলা প্রশাসন, বহু প্রতীক্ষিত সেই সিউড়ি শহরের জলপ্রকল্পই মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে শাসক দলের। তাই শেষমেশ ভোটের ঠিক পাঁচ দিন আগে পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রীকেই মাঠে নামিয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা করল তৃণমূল। সোমবার সকালে দলের রোড-শো থেকে ফিরহাদ হাকিমের নামে প্রচারিত একটি লিফলেটে প্রকল্পের ‘বিলম্বের জন্য’ শহরবাসীর কাছে ‘ক্ষমাপ্রার্থী’ হতে দেখা গেল রাজ্যের শাসক দলকে। অবশ্য তার জন্য ওই লিফলেটে খোদ দফতরের মন্ত্রী হয়েও এ বিষয়ে ‘প্রশাসনিক বিলম্ব’কেই দুষতে দেখা গিয়েছে ফিরহাদকে। এমনকী, ওই প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে সরব হওয়া দলেরই বিধায়ককে মন্ত্রী নাম না করে ‘মিরজাফরে’র তকমাও দিয়ে দিয়েছেন!
ঘটনা হল, ওই লিফলেট এ দিন বিলি হলেও সেখানে তারিখ দেওয়া হয়েছে গত ১৫ মার্চের। নির্বাচনী বিধিভঙ্গ এড়াতেই তৃণমূল এমন পন্থা নিয়েছে বলে দলীয় সূত্রের খবর। তৃণমূল নেতাদের দাবি, নির্বাচনি বিধি জারির আগেই ওই লিফলেট এসেছিল। এ দিন তা বিলি করা হয়েছে মাত্র। যদিও এর মধ্যে নির্বাচনী বিধিভঙ্গই দেখছেন বিরোধীরা। শহর কংগ্রেস নেতা চঞ্চল চট্টোপাধ্যায়, সিপিএমের সিউড়ি জোনাল সম্পাদক দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়, বিজেপি নেতা দীপক (বাবন) দাস, প্রত্যেকেই বলছেন, ‘‘নিজেদের দোষ ঢাকতে তৃণমূল নির্লজ্জ ভাবে এমন বেআইনি কাজ করছে। এটা নির্বাচনী স্টান্ট ছাড়া কিছুই না। ওরা ভাবছেন বারবার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষকে বোকা বানাবেন। ভোটের বাক্সেই মানুষ তৃণমূলের এই ভাঁওতাবাজির জবাব দেবেন!’’ এ দিনই সকালে আবার সিউড়ির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ত্রাণ সমিতির মাঠে প্রচারসভা করে জলপ্রকল্প নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও।
বস্তুত, মন্ত্রী-নেতা-কর্মীর বক্তব্য থেকে শুরু করে নির্বাচনী ইশতেহার— সবেতেই সিউড়ির জলসঙ্কট দূর করার আশ্বাস তৃণমূলের। মূলত এই প্রকল্প ঘিরেই তৃণমূল পুরবোর্ডের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে প্রথমে দলেরই কয়েক জন কাউন্সিলর পরে খোদ এলাকার বিধায়ক সরব হয়েছিলেন। যতই শাসকদল বাইরে কিছুই হয়নি ভাব দেখাক, যতই মুখে বলুক সিউড়ির ১৯টি ওয়ার্ডের সব ক’টিই তাদের দখলে থাকবে, জলপ্রকল্পের কাঁটা যে তৃণমূলকে খানিকটা ব্যাকফুটে ফেলেছে, তা গোপনে মানছেন দলের নেতা-কর্মীরাই। তৃণমূলের এক জেলা নেতার কথায়, ‘‘জলপ্রকল্পের কারণে বাসিন্দাদের একাংশের মধ্যে আমাদের সম্বন্ধে এক ধরনের অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। তা দূর করতে শেষ মুহূর্তে তাই দফতরের মন্ত্রীকে দিয়ে পুরনো প্রতিশ্রুতি রাখার আশ্বাস দিতে হচ্ছে।’’
এ দিন সকালে শহরে রোড-শো (যা পরে কার্যত একটি বড় মিছিলের চেহারা নেয়) করতে এসে শহরবাসীর কাছে দলীয় প্রার্থীদের জেতানোর আবেদন রাখেন রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। তখন কিছু না বললেও পরে সকাল ১১টা নাগাদ শহরের নেতাজি ইন্ডোর স্টেডেয়ামে কর্মিসভায় ঘুরে-ফিরে চলেই এল জলপ্রকল্পের কথা। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘সিউড়ির নির্বাচনটা আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পুরসভায় অনেক কাজ হয়েছে। অনেকগুলি কাজ এখনও বাকি। আমরা তিন মাসের মধ্যে অসমাপ্ত জলপ্রকল্পের কাজ শেষ করব। তার জন্য ইতিমধ্যেই ৫ কোটি টাকা ঘোষিত হয়েছে। কাজ করবে পুর ইঞ্জিনিয়ারিং দফতর। এটা ঘোষণা নয়। নির্বাচনি বিধি জারি না থাকলে এত দিনে কাজ শুরু হয়ে যেত।’’ পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি দলের সাসপেন্ডেড বিধায়ক স্বপন ঘোষের বিরুদ্ধে তোপ দাগেন। ফিরহাদ বলেন, ‘‘মনে হয় ওর মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। না হলে আদর্শগত ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা করে, এমন উন্মাদ আমি দেখিনি!’’ পরে তাঁর মন্তব্য, ‘‘প্রত্যেক জায়গায় প্রত্যেক যুগে কেউ না কেউ থাকে, যে পার্টিকে পিছন থেকে ছুরি মারার চেষ্টা করে। আজকের যুগেও মিরজাফর আছে। যাঁরা পার্টিকে হেয় করার চেষ্টা করে। কিন্তু মিরজাফরদের ইতিহাসে ঘৃণ্য ভাবেই দেখা হয়।’’ ফিরহাদের বক্তব্যকে পাত্তা দিচ্ছেন না স্বপনবাবু। তাঁর পাল্টা দাবি, ‘‘এই পাগলকে চিনতে ববি হাকিম আপনার এত দিন সময় লেগে গেল? চার বছর? সিউড়ির জলপ্রকল্প নিয়ে আপনারা কী রকম দুর্নীতি করেছেন, সেই সত্যিটা আমি প্রমাণ করেই ছাড়ব!’’
ফিরহাদ মুখে এ দিন সহজেই সিউড়ি দখল করার দাবি করছেন। মন্ত্রীর সেই দাবিকে দিবাস্বপ্ন বলেই মনে করছেন বিরোধীরা। সিউড়ি শহর কংগ্রেস নেতা চঞ্চলবাবু বলছেন, ‘‘যে মন্ত্রী বিধানসভায় দাঁড়িয়ে সিউড়ির জলপ্রকল্প নিয়ে মিথ্যা কথা বলতে পারেন, ভোট এসে গিয়েছে বলে এক দিন শহর ঘুরতে এসে তিনি যে বাসিন্দাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই পুরসভায় দুর্নীতি মন্ত্রীর প্রশ্রয়েই হয়েছে। তিনি তার দায় এড়াতে পারেন না।’’ অন্য দিকে, সিপিএমের সিউড়ি জোনাল সম্পাদক দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘এই শহরের মানুষ জানেন, তাঁরা প্রত্যেক দিন এক ফোঁটা জলের জন্য কেমন লড়াই করেন। তৃণমূল গতবারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিছু করতে পারেনি। এ বার ‘ব্যাক ডেটে’ পুরমন্ত্রীকে দিয়ে আশ্বাস দিয়ে নির্বাচনী স্টান্ট দিচ্ছে। আসলে তৃণমূল বুঝে গিয়েছে, জলপ্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে শহরবাসীর কাছে ওদের বলার মতো কিছু নেই। তাই এই রাস্তা।’’ পুরমন্ত্রীর আশ্বাসকে পাত্তা দিচ্ছেন না দীপকবাবুও। বিজেপি নেতার দাবি, ‘‘ববি একাধিক বার এ রকম মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁর কথা আর সিউড়ির মানুষ বিশ্বাস করেন না। আমরাই এ বার বোর্ড গড়ে সিউড়ির ঘরে ঘরে জল পৌঁছে দেব।’’
প্রচারে এসে বহু চর্চিত জলপ্রকল্পের কথা উঠে এসেছে অধীরের বক্তব্যেও। এ দিন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বলেন, ‘‘কেন্দ্র সরকার প্রতিটি পুরসভাকে অর্থ সাহায্য করে। সেই অর্থ আসে পরিকাঠামো উন্নয়ন, পানীয় জল ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার জন্য। সিউড়ি পুরসভাও সেই সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু, তার সদব্যবহার করেনি। যদি সদব্যবহার করত, তা হলে এই সমস্যা থাকার কথা নয়। উল্টে সেই পানীয় জল নিয়েও দুর্নীতি করেছে। এটা আমি বলছি না, ওদের দলের বিধায়কই বলছেন!’’ এর পরেই তাঁর সংযোজন, ‘‘সামনে ভোট। সিউড়ির মানুষ প্রশ্ন করুন, আপনাদের ঘরে ঘরে আজও কেন পানীয় জল পৌঁছল না? কেন বস্তি উন্নয়নের টাকায় ঘর তৈরি হল না? ১০০ দিনের কাজের টাকা কীভাবে কোন খাতে খরচ হচ্ছে? তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের আপনারা প্রশ্ন করুন।’’ তাঁর উত্তর মিলবে না বলেই বিরোধীদের দাবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy