এই গর্তেই দুর্ঘটনা।নিজস্ব চিত্র
সকাল থেকেই একের পরে এক গাড়ি ঢুকছিল আখড়াশাল গ্রামে। আসছিলেন প্রশাসনের তাবড় কর্তারা। জনপ্রতিনিধিরা। তাঁরা এলেন। সব দেখলেন। কথা বললেন মৃত তিন বালিকার পরিজনেদের সঙ্গে। আর ফিরে যাওয়ার পরে দুর্ঘটনাস্থল ঘিরে দেওয়া হল দড়ি দিয়ে। মৃত রিয়া বাউড়ির মামা ভজন বাউড়ি বললেন, ‘‘এইটাই যদি আগে করত, তা হলে অকালে বাচ্চাগুলোর প্রাণ যেত না।’’
রবিবার দুপুরে পাত্রসায়রের আখড়াশোল গ্রামে রাস্তার পাশে খুঁড়ে রাখা গর্তে মাটি চাপা পড়ে মৃত্যু হয় তিন বালিকার। জখম আরও দু’জন। সম্পর্কে তারা সবাই তুতো ভাইবোন। সোমবার সকালে গ্রামে ঢোকার বেশ কিছুটা আগে থেকেই কানে আসছিল কান্নার রোল। ভোরেই গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিলেন পাত্রসায়র পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পার্থপ্রতিম সিংহ। ব্লক তৃণমূলের পক্ষ থেকে মৃতদের পরিবারকে দশহাজার টাকা করে দেওয়া হয়।
ইন্দাসের বিধায়ক গুরুপদ মেটে গিয়ে পরিবারগুলিকে পনেরো হাজার করে টাকা আর এক বস্তা করে চাল দেন। ওন্দার বিধায়ক অরূপ খান জানান, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে পরিবারগুলিকে এক লক্ষ করে টাকা দেওয়া হয়েছে। আহতদের পরিবার পিছু পাঁচ হাজার টাকা। গিয়েছিলেন শালতোড়ার বিধায়ক স্বপন বাউড়ি এবং জেলা যুব তৃণমূলের সভাপতি রাজীব ঘোষাল।
গিয়েছিলেন জেলা সভাধিপতি মৃত্যুঞ্জয় মুর্মু, জেলাশাসক উমাশঙ্কর এস, পুলিশ সুপার কোটেশ্বর রাও, মহকুমাশাসক (বিষ্ণুপুর) মানস মণ্ডল, এসডিপিও (বিষ্ণুপুর) সুকোমলকান্তি দাস। জেলাশাসক বলেন, ‘‘মৃতদের পরিবার পিছু দু’লক্ষ টাকা করে আজ বিকেলেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দেওয়া হবে। পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরে যোগাযোগ করা হয়েছে। সেখান থেকেও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।’’ রাজ্যের নির্দেশ অনুযায়ী পরিবার পিছু এক জনকে চাকরি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জেলাশাসক। আর গীতাঞ্জলি প্রকল্পে দেওয়া হবে বাড়ি। জেলাশাসক বলেন, ‘‘আহতদের চিকিৎসার পুরো খরচ প্রশাসন দেবে।’’
গ্রামে জেলাশাসক ও অন্য কর্তারা। নিজস্ব চিত্র
সাহায্য আসছে। প্রতিশ্রুতি আসছে। আর যে গর্তে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার থেকে কয়েক হাত দূরেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন বাড়ির মহিলারা। মৃত রিয়ার মা রূপা বাউড়ি কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, ‘‘কত বড় বড় লোক চলে আসছে,
শুধু আমার মেয়েটাই ফিরছে না’’ শিল্পার মা মণি বাউড়ি বলছিলেন, ‘‘আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে দাও। ও আমার পাশে ছাড়া ঘুমোতে পারে না।’’ পাশে তখন চুপ করে দাঁড়িয়ে জনপ্রতিনিধিরা।
শিল্পার পিসি লক্ষ্মী বাউড়ি জানান, স্নান করতে যাবে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল ওরা। রিয়ার বাবা দিলীপ বাউরি জানান, তাঁরা মাঠে ধান রোয়ার কাজ করছিলেন। হঠাৎ শিল্পার ভাই দেবের চিৎকার কানে আসে সবার। ছুটে আসেন। দেব বলে, ‘‘আমরা খালের ভিতরে লুকোচুরি খেলছিলাম। হঠাৎ রাস্তার পাশের মাটি দিদিদের উপরে পড়ে গেল। খুব ভয় পেয়ে চিৎকার করতে শুরু করি।’’
সবাই মিলে কোদাল আর বেলচা নিয়ে মাটি সরিয়ে উদ্ধারের কাজ শুরু করেন। একেবারে উপরে ছিল বৃষ্টি। উদ্ধারের সময়ে চোট লাগে তার। আপাতত বাঁকুড়া মেডিক্যালে চিকিৎসা চলছে ছোট্ট মেয়েটির। তার নীচে ছিল কৃষ্ণ বাউড়ি। বিষ্ণুপুর হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে সে। কৃষ্ণর অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তারও নীচে চাপা পড়েছিল পূজা, শিল্পা আর রিয়া। তাদের বাঁচানো যায়নি।
রিয়া আখড়াশাল হাইস্কুলের ছাত্রী ছিল। পূজা এবং শিল্পা পড়ত আখড়াশাল প্রাথমিক স্কুলে। সোমবার সকাল ১১টা নাগাদ দুই স্কুলের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক শিক্ষিকারা শোক মিছিল করেন। মৃতদের পরিবারের সঙ্গেও দেখা করেন তাঁরা। আখড়াশাল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সুখদেব পরামানিক বলেন, ‘‘খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে ছিল রিয়া।’’
বাড়ির উঠোনে মেয়ের বন্ধুদের দেখে তখন অঝোরে কেঁদে চলেছেন শিল্পার মা মণি বাউড়ি। অষ্টম শ্রেণির সুজয় মাঝির দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল জল। সে বলে, ‘‘লুকোচুরি খেলা আর কখনও জমবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy