নতুন বাবা-মায়ের সঙ্গে ভাব জমানো। —নিজস্ব চিত্র
হিন্দিতে প্রবাদ আছে —‘কাহাঁ রাজা ভোজ, কাহাঁ গঙ্গু তেলি’। সেই প্রবাদটাকেই একটু উল্টে বাঁকুড়া জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বুধবার হেসে বলছিলেন, ‘কাহাঁ ইতালি, অওর কাহাঁ ছাতনা’!
কেন বলছিলেন?
কারণ, বাঁকুড়া জেলার প্রত্যন্ত ব্লক ছাতনার সঙ্গে ‘সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পার’-এর ইতালির সম্পর্ক গড়ে দিয়েছে ছোট্ট মেয়ে বৈশাখী!
কী ভাবে?
জন্মের পর থেকেই ছাতনার এক হোমে কাটানো আট বছরের বৈশাখী বাবা-মা হিসাবে পেল যে দম্পতিকে, তাঁরা যে জুভেন্তাস, এ সি মিলানের দেশের প্রাতো শহরের বাসিন্দা!
তবে এ কোনও ফিল্মি গল্প নয়। কঠোর বাস্তব। যেমন বাস্তব বৈশাখীর বেঁচে থাকাটাই! ২০০৭ সালের নভেম্বরে পুরুলিয়ার আড়শায় ঘন জঙ্গলের ঝোপের ভিতর থেকে কান্নার আওয়াজ শুনে জড়ো হয়েছিলেন স্থানীয় লোকজন। ঠান্ডায়, পোকা-মাকড়ের উপদ্রবে শিশুটির নাজেহাল দশা। তাঁরাই উদ্ধার করে এক শিশুকন্যাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। মা-বাবার হদিস মেলেনি। পাঁচ মাস হাসপাতালে কাটানোর পরে শিশুকল্যাণ কমিটির নির্দেশে ছাতনার চামট্যাগড়ার হোমে ঠাঁই হয় সেই সদ্যোজাতের। সেই থেকে বৈশাখী নাম নিয়ে বেড়ে উঠেছে সে।
বাঁকুড়ার ইতিহাসে এই প্রথম কোনও অনাথ শিশুকে দত্তক নিল কোনও বিদেশী দম্পতি। স্বভাবতই ঘটনাটি নিয়ে বাঁকুড়ার প্রশাসনিক মহলে আলোচনার শেষ নেই। জেলা শিশু সুরক্ষা ইউনিটের সুরক্ষা আধিকারিক তথা বাঁকুড়া জেলা দত্তক কমিটির চেয়ারপার্সন দুলালচন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন, “বাঁকুড়ার ইতিহাসে এই প্রথম কোনও শিশুকে বিদেশি দম্পত্তি দত্তক নিল। বৈশাখী তার মা-বাবার কাছে কেমন ভাবে মানিয়ে নিচ্ছে, নিয়ম মেনে সেই রিপোর্ট ইতালির দত্তক সংস্থা বাঁকুড়ার জেলা জজের কাছে রুটিন মাফিক পাঠাবে।’’ জেলা শিশু সুরক্ষা আধিকারিক পার্থসারথি মণ্ডলের কথায়, “ইতালির ওই দম্পতি যে ভাবে বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত এলাকার এক শিশুকন্যাকে নিজের করে নিলেন, তা প্রশংসনীয়। ব্যতিক্রমী তো বটেই।’’
সুদূর ইতালির ওই দম্পতির সঙ্গে ছাতনার হোমের বৈশাখীর যোগাযোগ করে দেওয়ার পিছনে রয়েছে কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের অধীনে থাকা ‘সেন্ট্রাল অ্যাডপশন রিসোর্স অথরিটি’ বা কারা। প্রশাসনিক সূত্রে জানা যাচ্ছে, ২০১৪ সালের আগে পর্যন্ত এ রাজ্যের মাত্র চারটি দত্তক সংস্থা বিদেশে শিশু দত্তক দেওয়ার ছাড়পত্র পেয়েছিল। তবে, ওই বছরের অগস্ট থেকে ‘কারা’ অনলাইনের মাধ্যমে দত্তক দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। এর ফলে দেশের প্রায় সব ক’টি দত্তক সংস্থাই নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে বিদেশে শিশুদের দত্তক দেওয়ার ছাড়পত্র পেয়েছে। ইতালির প্রাতো শহরের নিঃসন্তান দম্পতি ভ্যালেনটিনি উলিসি ও ব্যারোনচেল্লি গুইয়া ইতালির একটি দত্তক সংস্থার মাধ্যমে কারা এবং ভারতের বিদেশি দত্তক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে।
সেখান থেকে চামট্যাগড়ার বৈশাখীর ছবি ও তার সংক্রান্ত তথ্য পান তাঁরা। গোটা প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হতে সময় লেগে যায় প্রায় দু’বছর। যাবতীয় সরকারি নিয়ম কানুন মেনে অবশেষে মঙ্গলবার চামট্যাগড়ার হোম থেকে বৈশাখীকে নিজেদের কন্যা হিসবে পান ওই দম্পতি। বৈশাখী হেফাটাইটিস বি-রোগে আক্রান্ত। তবে, তাঁদের দেশে এই অসুখ সারানোটা কোনও বড় ব্যাপার নয় বলে জানিয়েছেন ওই দম্পতি। উলিসির কথায়, “ভারতীয় দত্তক সংস্থা আমাকে বৈশাখীর শারীরিক অবস্থা নিয়ে সঠিক রিপোর্ট দিয়েছিল। এই সততাটা ভাল লেগেছে।’’ পাঁচ বছরের বৈবাহিক জীবন কেটেছে নিঃসন্তান হিসেবে। এ বার বৈশাখীকে পেয়ে সত্যিকারের মা হওয়ার আনন্দ হচ্ছে বলেই জানালেন ব্যারোনচেল্লি। বৈশাখীকে বুকে আঁকড়ে ধরে বলছিলেন, “এই আমাদের ভবিষ্যৎ। একে নিজেদের মতো করে মানুষ করে তুলব।’’ পাশ থেকে উলিসি বললেন, “আমরা ওর বাবা মা। তা বলে বৈশাখীকে তার নিজের দেশ ভুলতে দিতে চাই না। ভবিষ্যতে যাতে ভারতকে ও ভাল ভাবে জানে, সেই চেষ্টাই করব।’’
দীর্ঘ আট বছরের সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটে যাওয়ায় চামট্যাগড়া হোম কর্তৃপক্ষ ও বৈশাখীর বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যেও যেন বিষাদের ছায়া। ওই হোমের সম্পাদিকা গঙ্গামনি সরেনে বলেন, “একরত্তি মেয়েটাকে সেই কবে থেকে মানুষ করেছি। তাই আমাদের মন খারাপ। তবে ওর ভবিষ্যৎ ভাল হবে ভেবে খুশিও হচ্ছি।’’ নতুন বাবা-মা পেয়ে খোশমেজাজে রয়েছে সেই মেয়েটিও।
আপাতত ওরা তিন জন কলকাতায়। কয়েক দিনের মধ্যেই দমদম থেকে স্বপ্নের উড়ান। প্রাতো যাবে ছাতনার বৈশাখী!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy