মায়ের আদর। দুবরাজপুরের বাড়িতে মাধ্যমিকে দ্বিতীয় রমিক দত্ত। মঙ্গলবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
পরীক্ষা ভাল হয়েছিল, ভাল ফল ভাল হবে— এমন প্রত্যাশা ছিলই। তাই বলে, পর্ষদ ঘোষিত মেধা তালিকায় সেরাদের মধ্যে স্থান!
এমন ‘চমক’ আশা করেনি দুবরাজপুর শ্রী শ্রী সারদা বিদ্যাপীঠের ছাত্র রমিক দত্ত। মেধা তালিকায় রাজ্যে সে দ্বিতীয় স্থান করে নিয়েছে ৬৮২ নম্বর পেয়ে। ঠিক যেমন রেজাল্ট দেখে খুশি রামপুরহাট জিতেন্দ্রলাল বিদ্যাভবনের অনীক ঘোষ। এবারে মেধা তালিকায় সে তৃতীয় হয়েছে। তার প্রাপ্ত নম্বর ৬৮১। আর ষষ্ট হয়েছে তারই বন্ধু সৌমেন্দু বাগ। তার প্রাপ্ত নম্বর ৬৭৮। নিজের রেজাল্ট দেখে বিশ্বাস করতে পারেনি রামপুরহাট গার্লস হাইস্কুলে এবারের সর্বোচ্চ নম্বরের প্রাপক সায়নী দত্ত। ঘড়িতে যখন বিকেল পাঁচটা, তখন সে জানতে পারে জেলাতে মেয়েদের মধ্যে সেই প্রথম! বার বার বাবাকে জিজ্ঞেস করে, ‘‘কী হবে বাবা? সত্যিই কি আমি!’’ সায়নী ইংরেজিতে পেয়েছে ৯০, বাংলায় ৯৩, অঙ্কে ৯৯, ভৌতবিজ্ঞানে ১০০, জীবনবিজ্ঞানে ৯৯, ইতিহাস ৯২ এবং ভূগোলে ৯৮।
মঙ্গলবার সন্ধেয় এই তিন মেধাবী ছাত্রকে নিয়েই কার্যত চর্চা হয়েছে দুবরাজপুর থেকে রামপুরহাট, বোলপুরে। টেলিভিশনে যখন ‘লাইভ’ অনুষ্ঠানে বসে নিজেদের সাফল্যের কথা শোনাচ্ছেন রমিক ও অনীক, জেলাজুড়ে চলে তাদের নিয়ে আলোচনা। বাড়ির উঠোনে তখনও ভিড় পড়শিদের। মোবাইলে তখনও আসছে পরিজনদের শুভেচ্ছা-বার্তা। এতো ভাল ফল করে স্বভাবতই দিনভর খুশিতে থাকতে দেখা গিয়েছে রমিককে। সে বাংলায় ৯৮, ইংরাজিতে ৯৬, অঙ্কে ১০০, ভৌতবিজ্ঞানে ১০০, জীবনবিজ্ঞানে ৯৮, ইতিহাসে ৯৩ এবং ভূগোলে ৯৭ পেয়েছে। তার এই সাফল্যে আপ্লুত তার বাবা-মা, আত্মীয় পরিজন, বন্ধু, প্রতিবেশী থেকে জেলাবাসী সকলেই। এবং অবশ্যই গর্বিত রমিকের স্কুলের শিক্ষকেরা।
এ দিন সকালে খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই দুবরাজপুর স্টেশনমোড় সংলগ্ন রমিকদের ভাড়া বাড়িতে ভিড় জমাতে শুরু করেন সকলে। সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা। আদতে ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা, বর্ধমানের উখড়ায় কর্মরত জীবনববীমা সংস্থার কর্মী রমিকের বাবা মলয় রঞ্জন দত্ত ও রিঙ্কু মণ্ডলদের তখন ব্যস্ততার শেষ নেই। একদিকে লাগাতার মোবাইল ফোনে ছেলের কৃতিত্বের খবরাখবর দিচ্ছেন, সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন, অন্যদিকে বাড়িতে যাঁরা অভিনন্দন জানাতে এসেছেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন।
‘‘কী যে খুশি হয়েছি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। ছেলের লেখাপাড়ার জন্যই বাড়ি ভাড়া নিয়ে ছিলাম এতোগুলো বছর। আজ সেটা সার্থক হল রমিকের রেজাল্টে,’’ ছেলের সাফল্যে প্রতিক্রিয়া মলয়রঞ্জন ও রিঙ্কুদেবীর। স্কুলে এক সহপাঠী সবসময় রমিকের থেকে এগিয়ে থেকেছে। কিন্তু এবারই টেস্টের রেজাল্টে সেই সহপাঠীকে ছাপিয়ে যায় সচিন তেণ্ডুলকারের অন্ধ ভক্ত রমিক।
সচিন কেন?
রমিকের সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘‘সচিন ভদ্র, বিনয়ী। কোনও কিছুর কাছে হার না মানা প্লেয়ার।’’
তৃতীয় অনীক ঘোষ, ষষ্ঠ সৌমেন্দু বাগ ও দশম শুভম মিশ্র। —নিজস্ব চিত্র
তাঁর সহপাঠী সুপ্রিয় সেন, রহিত দাঁ-রা জানাচ্ছে, ‘‘তখনই আন্দাজ করেছিলাম ও ভাল ফল করবে।’’ অতন্ত্য বিনয়ী ছাত্রটি যে রাজ্যের সেরাদের মধ্যে স্থান পেতে পারে তা আন্দাজ করেছিলেন শিক্ষকেরাও। ‘‘আমরা গর্বিত,’’ বলছেন স্কুলের টিচার ইনচার্জ শুভাশিস চট্টোরাজ এবং রামকৃষ্ণ আশ্রমের শীর্ষ সেবক স্বামী সত্যশিবা নন্দ।
রমিক বলছেন, ‘‘এতটা ভাল ফল অপ্রাত্যশিত।’’ নিজের ভাল ফলের জন্য নিজের বাবা, মা ও ব্যক্তিগত শিক্ষক ও নিজের মামা দাদুর অবদানের কথাই বলছে সে। তার বাড়িতে যখন খুশির হাওয়া প্রায় একই ছবি সিউড়ি কলেজপাড়ায় শুভম মিশ্রদের বাড়িতে। হওয়ারই কথা। মেধা তালিকায় দশম স্থানে যে জায়গা পেয়েছে সিউড়ির ইংরাজী মধ্যমস্কুল সেন্ট অ্যান্ড্রুজের ওই ছাত্রও। এ বার সে পেয়েছে ৬৭৪ নম্বর। বাংলায় ৯৫, ইংরাজিতে ৯২, অঙ্কে ১০০, ভৌতবিজ্ঞানে ১০০, জীবনবিজ্ঞানে ৯৮, ইতিহাসে ৯০ এবং ভূগোল ৯৯ পেয়েছে।
৬৭০ এর উপর নম্বর উঠবে— পরীক্ষা দেওয়ার পর এমটা ধরেই রেখে ছিল শুভম। সেটাই হয়েছে। তাই খুশি সে। খুশি ওর পরিবার আত্মীয় এবং শিক্ষকেরাও।
শুভমের বাবা পেশায় ব্যবসায়ী প্রশান্ত মিশ্র, মা আইসিডিএস কর্মী শর্মিষ্ঠা মিশ্র বলছেন, ‘‘এর থেকে খুশির আর কী বা হতে পারে। সকালে তাই চোখ ছিল টিভিতে। ছেলের নাম ঘোষণার পর মনে হল স্বপ্ন সফল হল।’’ শুভমের ইচ্ছে ভবিষ্যতে সে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হবে। স্কুলের অধ্যক্ষ জেরাল্ড ফ্রাঙ্ক পিটার্স বলছেন, ‘‘শুভম আমাদের স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করেছে।’’
প্রতীক্ষা শেষে সাফল্যের উচ্ছ্বাস। মঙ্গলবার রামপুরহাটের একটি স্কুলে তোলা নিজস্ব চিত্র।
অন্য দিকে, মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিকে প্রায় প্রতি বছর জেলা ছাড়িয়ে রাজ্যে রামপুরহাট জিতেন্দ্রলাল বিদ্যাভবন একটা পরিচিত নাম। অনীক ও সৌমেন্দুর রেজাল্ট দেখে খুশি স্কুলের শিক্ষকরা। অনীক ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চায়। সৌমেন্দু চায় ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষায় ভাল র্যাঙ্ক করে প্রশাসনিক স্তরে ভালো অফিসার হতে।
অনীকের বাবা শিবপ্রসাদ ঘোষ মৎস্য দফতরের বীরভূম জেলা আধিকারিক পদে রয়েছেন। মা মৌসুমী ঘোষ গৃহবধূ। ছেলের সাফল্যে খুশি তাঁরা। খুশি, সৌমেন্দুর বাবা, সেচ দফতরের কর্মী সুখেন্দু বিকাশ বাগ ও মা সুধারানি বাগ। স্কুলের প্রধানশিক্ষক গৌরচন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘‘ভালো রেজাল্টের জন্য অবশ্য ছাত্রদের পড়াশুনার প্রতি আগ্রহকেই বড় করে দেখব। এর বাইরে স্কুলের শিক্ষকদের অবদানও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।’’ অন্যদিকে নবম শ্রেণি থেকেই সাত জন প্রাইভেট শিক্ষক ছিল সায়নীর। পড়ার কোনও ধরাবাঁধা সময় ছিল না তার। ভবিষ্যতে সে ডাক্তার হতে চায়। ফেসবুক কিংবা হোয়াটসঅ্যাপ করতে ভাল না বাসলেও, টিভিতে প্রিয় অনুষ্ঠান রিয়ালিটি শো। শায়নীর মা দীপালি দত্ত বলেন, ‘‘তাই বলে কখনও পড়াতে ফাঁকি দিয়ে টিভি নয়।’’ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছায়া চট্টোপাধ্যায় জানালেন, ‘‘ও খুব ভালো মেয়ে। ওদের কয়েকজনের প্রতি আমাদের নজর ছিল। ওরা ভাল রেজাল্ট করে স্কুলের সুনাম বজায় রেখেছে।” সায়নীর বাবা অমিত দত্ত বলেন, ‘‘আর্শীবাদ করুন, মেয়ে যেন আরো ভাল রেজাল্ট করতে পারে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy