(বাঁ দিকে) তোপ দাগা হচ্ছে বিষ্ণুপুরে। মল্লরাজাদের কূলদেবী মৃন্ময়ীর বিগ্রহ (ডান দিকে)। এই বিগ্রহের নিরঞ্জন হয় না। — নিজস্ব চিত্র।
রাজা নেই, নেই রাজত্বও। তবু নিয়ম মেনে কৃষ্ণা নবমীতে দেবী আসেন। স্থানীয় মাধব সায়রে মহাস্নান পর্বের পর বড় ঠাকুরানি প্রবেশ করেন সুপ্রাচীন মন্দিরে। রীতি মেনে মাধব সায়রের পাড় থেকে গর্জে ওঠে কামান। ঢাক-ঢোল, কাঁসর, সানাইয়ের শব্দে দেবীর আগমন হয়। গত ১ হাজার ২৮ বছরের রীতি মেনে বৃহস্পতিবার এ ভাবেই মল্লগড় বিষ্ণুপুরে শুরু হয়ে গেল রাজ কূলদেবী মৃন্ময়ীর পুজো।
হাজার বছরের প্রাচীন রীতি মেনে দুর্গাপুজো শুরু হওয়ার প্রায় ১৫ দিন আগে কৃষ্ণা নবমী তিথিতে মৃন্ময়ী পুজো শুরু হয়ে যায় বিষ্ণুপুরে। সকালে বিষ্ণুপুরের ফৌজদার পরিবারের হাতে আঁকা বড় ঠাকুরানির পট নিয়ে রাজ পুরোহিতেরা উপস্থিত রাজ দরবার লাগোয়া মাধব সায়র নামের পুকুরে। হাজির হন রাজ পরিবারের সদস্যেরাও। সেখানে পুজোপাঠের মধ্য দিয়ে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। এর পর শোভাযাত্রা করে সেই পট রাজ পুরোহিতেরা নিয়ে আসেন মৃন্ময়ী মন্দির চত্বরে।
মন্দির চত্বরে বড় ঠাকুরানির প্রবেশের মুহূর্তে মাধব সায়রের পাড় থেকে তিনটি তোপধ্বনি করা হয়। এর পর পট রাখা হয় মন্দির চত্বরের একটি বেদীতে। সেখানে আবার পুজোপাঠের পর রাজ পরিবারের সদস্যেরা দেবীকে বরণ করেন। এর পর পান পাতায় পা রেখে দেবী প্রবেশ করেন মৃন্ময়ীর মূল মন্দিরে। মূল মন্দিরে প্রবেশের মুহূর্তে আরও তিনটি তোপধ্বনি করা হয় মাধব সায়রের পাড় থেকে।
রাজ পুরোহিত সোমনাথ মুখোপাধ্যায় জানান, মৃন্ময়ীর পুজো পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা। মল্লরাজ পরিবারের স্বতন্ত্র বলীনারায়ণী পুঁথি অনুসারে এই পুজো হয়। পুজোর সুপ্রাচীন নিয়ম অনুসারে কৃষ্ণা নবমীতে মন্দিরে আসেন বড় ঠাকুরানি অর্থাৎ মহাকালী। এর পর মান চতুর্থীর দিন একই ভাবে মন্দিরে আসেন মেজো ঠাকুরানি অর্থাৎ মহাসরস্বতী এবং ষষ্ঠীর দিন মন্দিরে আসেন ছোট ঠাকুরানি অর্থাৎ মহালক্ষ্মী। অষ্টমী এবং নবমীর মধ্যরাতে মন্দিরে পুজো হবে খচ্চরবাহিনী বা মহামারীর। মহামারী থেকে প্রজাদের বাঁচাতেই এই পুজোর প্রচলন বলে শোনা যায়। কথিত রয়েছে, অতীতে শাক্ত মতে এই পুজো হত। হত নরবলিও। কিন্তু শ্রীনিবাস আচার্যের সান্নিধ্যে এসে মল্ল রাজ পরিবার বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর থেকেই বলি বন্ধ হয়ে যায়। বদলে শব্দকে ব্রহ্মজ্ঞান করে সময় নির্ঘণ্ট অনুযায়ী তোপধ্বনি করা হয়।
এক হাজার বছর আগে মল্লরাজাদের রাজধানী ছিল জয়পুরের প্রদ্যুম্নপুর গ্রামে। কথিত রয়েছে, মল্লরাজ জগৎমল্ল শিকারে বেরিয়ে একবার পথ ভুলে চলে আসেন বন বিষ্ণুপুরে। ক্লান্ত শরীরে জঙ্গলের মধ্যে একটি বটগাছের তলায় তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। তখন নাকি বিভিন্ন দৈব ঘটনা ঘটতে থাকে। পরে তিনি ঈশ্বরের নির্দেশে ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ওই বটগাছের তলায় দেবী মৃন্ময়ী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী কালে তিনি মল্ল রাজধানী প্রদ্যুম্নপুর থেকে সরিয়ে বিষ্ণুপুরে নিয়ে আসেন। এর পর থেকেই মহাধুমধামে শুরু হয় দেবীর পুজো। অতীতে ঘটা করে হত পুজো। তবে এখনও নিষ্ঠা, ভক্তির সঙ্গেই হয় পুজো।
এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিষ্ণুপুরের মানুষের আবেগ। রাজ পরিবারের সদস্য জ্যোতিপ্রসাদ সিংহ ঠাকুর বলেন, ‘‘এই পুজোর নিয়ম-নীতি রয়েছে প্রথম দিন থেকে প্রায় একই রকম। এক সময় মৃন্ময়ীর তোপধ্বনি শুনে গোটা মল্ল রাজত্ব, এমনকি, গোটা রাঢ়বঙ্গে পুজোর নির্ঘন্ট হিসাব করা হত। এখন অত জোরে আর হয় না তোপধ্বনি। শুধু বিষ্ণুপুর নয় গোটা রাজ্য, দেশ এমনকি, বিদেশ থেকেও বহু মানুষ এই পুজোর টানে এই সময় ছুটে আসেন বিষ্ণুপুরে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy