(বাঁ দিক থেকে) নীলকন্ঠ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির বারান্দায় পুরুলিয়াবাসীর সঙ্গে সুভাষচন্দ্র। সেই ঘরের সামনে জমে জঞ্জাল (নিজস্ব চিত্র)।
ছাদে অশ্বত্থ, কার্নিসে আগাছা, উঠোনের কোণে ডাঁই করে রাখা জ্বালানি কাঠ। একটি ঘরের দরজায় ঝুলছে মরছে ধরা তালা। কে বলবে, ১৯৩৯-এর ৯ ডিসেম্বর রামগড় আপস বিরোধী সমাবেশের প্রচারে এসে পুরুলিয়ার নামোপাড়ার এই বাড়িতেই উঠেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ওই ঘরেই তিনি বসেছিলেন। তাঁর চার বারের পুরুলিয়া সফরে সেটাই ছিল শেষ আসা। কালের প্রবাহে জরাজীর্ণ হয়ে পড়া নীলকন্ঠ চট্টোপাধ্যায়ের সেই ঘরই পূর্ণ মর্যাদায় সংরক্ষণের দাবি উঠেছে পুরুলিয়ায়। তবে নেতাজি যে ঘরে বসেছিলেন, সেই ঘরটি সংরক্ষণে তিনি উদ্যোগী হয়েছেন বলে জানিয়েছেন নীলকণ্ঠবাবুর উত্তরসূরী রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়।
পুরুলিয়ার ইতিহাস গবেষক দিলীপকুমার গোস্বামী জানান, শেষ বার পুরুলিয়ায় আসার বেশ কয়েক মাস আগে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস ছেড়ে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করেন। মানভূমে তাঁর সহযোদ্ধা ফরওয়ার্ড ব্লকের সংগঠক অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্তীর আত্মজীবনী ‘আমার জীবন’ থেকে জানা যায়, তিনি সুভাষচন্দ্রের বাড়িতে সফরের আগের দিন ফোন করেছিলেন। সে দিন সুভাষচন্দ্রের জ্বর হয়েছিল। কিন্তু তিনি জানান, পুরুলিয়া সফর বাতিল হবে না।
দিলীপবাবু জানান, হাওড়া-চক্রধরপুর ট্রেনে পুরুলিয়া স্টেশনে নামেন সুভাষচন্দ্র। নীলকন্ঠবাবুর হুডখোলা গাড়িতে চাপিয়ে শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়ির বাইরে প্রচুর মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। বাড়ির মহিলারা বৈঠকখানার ছাদ থেকে পুষ্পবৃষ্টি করেন। সুভাষবাবু ওঠেন অতিথিশালায়।
দিলীপবাবু বলেন, ‘‘বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে ছিলেন মতি নামের এক কর্মচারী। জ্বর ছিল বলে তিনি গরম জলে সুভাষচন্দ্রের গা মুছিয়ে দেন। নবকুষ্ঠাশ্রমের চিকিৎসক নিরঞ্জন মুখোপাধ্যায় (মেদ্দুবাবু) সুভাষচন্দ্রকে ওষুধ দেন। দু’টি রুটি, সামান্য সব্জি খেয়ে জেলা সফরে বেরিয়েছিলেন তিনি।’’ তিনি জানান, জ্বর গায়ে পুরুলিয়া শহরের জুবিলি ময়দান, তুলিন, কাশীপুর চকবাজার, হুড়ার লক্ষ্মণপুর, আনাড়া, ঝালদা প্রভৃতি নানা জায়গায় সভা করেছিলেন সুভাষচন্দ্র। রাতে তাঁকে আদ্রা স্টেশন থেকে ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়।
সেই ঘটনার সাক্ষী নবতিপর রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘তখন আমার বয়স আট বছর। সে ভাবে কিছুই বোঝার বয়স হয়নি। তবুও স্মৃতিতে আবছা হয়ে এখনও গেঁথে রয়েছে কিছু ছবি। পরে ঠাকুরদা ও বাবার কাছেও শুনেছি। সে দিন জলখাবারে রুটি-সব্জির সঙ্গে এক বাটি দুধও খেয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। উঠোনের এক পাশে রান্নাঘর ছিল। রাঁধুনি ছুটে ছুটে খাবার দিচ্ছিলেন।’’ দিলীপবাবু জানান, আড়াল থেকে বাড়ির মহিলারা দেখছেন বুঝতে পেরে, সুভাষচন্দ্র মাটিতে হাত দিয়ে তাঁদের প্রণাম জানান।
ওই বংশের উত্তরসূরী মুম্বই হাইকোর্টের আইনজীবী রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সুভাষচন্দ্রের পদধূলি পড়া ওই ঘরটিকে আমরা পূর্ণ মর্যাদায় সংরক্ষণ করতে চাই। ইচ্ছা রয়েছে, নেতাজি সংগ্রহশালা গড়া হবে। তবে ওই ঘর বর্তমানে এক ব্যবসায়ীর হেফাজতে রয়েছে। তিনি অবশ্য ব্যবহার করেন না। আমি জেলা প্রশাসনকে আমার ইচ্ছার কথা জানিয়ে চিঠি দিয়েছি।’’ কমল মিশ্র নামে ওই ব্যবসায়ীর দাবি, ‘‘ঘরটি অন্তত কুড়ি-বাইশ বছর ভাড়া নিয়ে ব্যবসার কাজে ব্যবহার করছি।’’
দিলীপবাবু থেকে নিস্তারিণী কলেজের বাংলার বিভাগীয় প্রধান প্রবীর সরকারেরা বলেন, ‘‘ওই ঘরে সংগ্রহশালা হলে, সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে পুরুলিয়ার সম্পর্ক আলোকিত হবে।’’ শহরের সংস্কৃতি কর্মী সুদিন অধিকারী বলেন, ‘‘আমার বাবা রামানন্দ অধিকারী সে দিন সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে ছিলেন। ওই ঘরের বেহাল অবস্থা দেখে খারাপ লাগে।’’
এই উদ্যোগে উৎসাহ দিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলিও। বিজেপিতে যোগ দেওয়া পুরুলিয়ার বিধায়ক সুদীপ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রাজ্যে বিজেপি সরকার এলে আমরা পূর্ণ মর্যাদায় ওই ঘরটিকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করব।’’ প্রদেশ কংগ্রেসের সম্পাদক পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় ও ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অসীম সিংহ জানান, প্রশাসন উদ্যোগী হলে তাঁরা অবশ্যই পাশে থাকবেন। জেলা তৃণমূলের মুখপাত্র নবেন্দু মাহালি বলেন, ‘‘এ ধরনের ইতিহাস বিজড়িত বাড়ি সংস্কার ও সংরক্ষণে মুখ্যমন্ত্রী কতটা আগ্রহী, তা সবাই জানেন। বাড়ির মালিক সরংক্ষণ চাইছেন। আমরা অবশ্যই সহায়তা করব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy