ঝোলাঝুলি: বাঁকুড়া শহরের বড়কালীতলায়। ছবি: অভিজিৎ সিংহ
পাড়ার অলিগলিতে ঢোকার আগে এখন ভাবতে হচ্ছে টোটো বা রিকশা চালকদের। পায়ে হেঁটেও স্বস্তি নেই। ব্যাপারটা অনেকটা চক্রব্যুহের মত। ঢোকা সহজ, কিন্তু বেরনো যাবে তো? খুদে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ বাঁকুড়া শহর।
কোথাও সাত-আট জন, কোথাও আরও বেশি। খুদে ছেলেমেয়েরা চাঁদার রসিদবই ধরে দাঁড়িয়ে থাকছে রাস্তার উপরে। টোটো, রিকশা, সাইকেল, মোটরবাইক আরোহীদের উপরে হামলে পড়ছে তারা। দাবি মতো চাঁদা না দেওয়া ইস্তক ছাড় নেই। হাত ধরে টানাটানি চলবে। ধমক দিলে খুদে মুখে কুকথাও শুনতে হতে পারে।
ভুক্তভোগী কেউ কেউ আবার বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ করা তো দূর, এলাকারই কিছু লোকজন চাঁদাবাজদের পক্ষে সওয়াল করতে চলে আসেন। শহরের বড়কালীতলা এলাকায় দেখা মিলল এমনই একটি দলের। নেত্রীর বয়স মেরেকেটে তেরো। রসিদবই হাতে দাঁড়িয়ে। গাড়ি আসতে দেখলে নির্দেশ দিচ্ছে— ‘‘আটকা’’। অমনি জনা ছয়েক খুদের ‘বাহিনী’ ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বাকিরা কেউ দ্বিতীয় শ্রেণি তো কেউ পঞ্চম। নেত্রী নিজে অষ্টম শ্রেণি। বলল, ‘‘কালীপুজো করব। চাঁদা তুলছি। সবাই তোলে। অন্যায়টা কী?’’
বাঁকুড়া শহরের দুবেরবাঁধ পাড় বা নুনগোলা এলাকার অলিগলিতেও একই দশা। লোকপুর মোড় থেকে রাজগ্রাম যাওয়ার রাস্তাতেই বড় গাড়ি আটকে চাঁদা তুলতে দেখা গিয়েছে দশ-বারো বালক ও কিশোর রসিদবই হাতে ওঁৎ পেতে আছে। ছাড় পাচ্ছে না অ্যাম্বুল্যান্সও। বাঁকুড়া শহরের গাড়িচালক বাপি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বাচ্চারা চাঁদা তুলতে গিয়ে এমন ভাবে গাড়ির সামনে হামলে পড়ছে, যে কোনও সময়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কেউ দেখেও যেন দেখে না। অঘটন কিছু হলে দায়টা কিন্তু চালকের উপরেই ফেলা হবে।’’
বাঁকুড়া শহরের টোটোচালক প্রবীর ঘোষ বলেন, “শহরের রাস্তায় টোটো চালানোই এখন দায়। চাঁদা তোলার নামে জবরদস্তি করছে বাচ্চারা। গাড়ির ছাদে উঠে বসে থাকছে।’’ লোকপুর-রাজগ্রাম রাস্তায় চাঁদাতুলিয়ে এক কিশোর জানায়, সে স্থানীয় হাইস্কুলে নবম শ্রেণির ছাত্র। দলের বাকিরাও একই স্কুলের। স্থানীয় পুজো কমিটির জন্য চাঁদা তুলছে। মুখে একই বুলি— ‘চাঁদা তোলায় অন্যায় কিছু নেই’।
তবে জেলা পুলিশের কর্তারা জানাচ্ছেন, চাঁদা তোলা বেআইনি। এই অপরাধের জন্য জেল বা মোটা টাকা জরিমানা হতে পারে। তবে নাবালক-নাবালিকাদের ক্ষেত্রে আইনের বেশি ক়ড়াকড়ি থাকে না। সে ক্ষেত্রে স্কুলগুলিই সচেতনতা তৈরিতে এগিয়ে আসতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। বাঁকুড়া সারদামণি গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ সিদ্ধার্থ গুপ্ত বলেন, “শিশুরাই সমাজের ভবিষ্যৎ। আজ যারা অলিগলিতে চাঁদা তুলে বেড়াচ্ছে, কাল তারাই বড় রাস্তায় গাড়ি আটকাবে। চাঁদা তোলা যে অপরাধ, সেই বোধটা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরেই মাথায় ঢোকানো দরকার।”
বাঁকুড়ার সঙ্গীতশিল্পী জয়দীপ মুখোপাধ্যায় বলেন, “রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে বড় বড় পুজো কমিটির লোকজন বাস বা ট্রাক আটকে চাঁদা তোলে। পুলিশ দেখেও দেখে না। কচিকাঁচারা পাড়ার অলিগলিতে এখন সেটাই করছে। প্রশাসনিক ভাবে স্কুলস্তরে চাঁদা তোলার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলাটা খুব জরুরি।’’
চাঁদা তোলার বিরুদ্ধে পড়ুয়াদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা বা পাঠ্যক্রমের মধ্যেও এই ধরণের বিষয় রাখা দরকার বলে মনে করেন পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির বাঁকুড়া জেলা সভাপতি গৌতম দাস। তিনি বলেন, “শিক্ষকদের সমাবেশে এই বিষয়টি তুলব। পাঠ্যক্রমে যাতে চাঁদা তোলার বিরুদ্ধে ছড়া বা প্রবন্ধ রচনার মতো বিষয় রাখা যায়, সেই দাবি রাজ্য সরকারের কাছেও জানাব আমরা।”
বাঁকুড়ার জেলাশাসক উমাশঙ্কর এস বলেন, “আমরা নানা বিষয়ে পড়ুয়াদের সচেতন করি। চাঁদা তোলার বিরুদ্ধে স্কুল স্তরে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো যেতেই পারে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy