Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪
১৬ জানুয়ারি দিদির ঘরে বৈঠকে নেতারা

কেষ্টর ক্লাসে কালীঘাটের হোমওয়ার্ক

ক্লাস নিতে হাজির কড়া হেডমাস্টার। আর তাঁর দাপটে তটস্থ পড়ুয়ার দল! রবিবার দুপুরে বোলপুর পুরসভার মঞ্চে ‘কেষ্টদার ক্লাস’-এর সাক্ষী হলেন জেলা তৃণমূলের বিভিন্ন স্তরের দু’শো নেতা। ক্লাসের শেষে মিলল বিশেষ ‘হোমওয়ার্ক’। দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ওই ক্লাসে ছিলেন সাংসদ, বিধায়ক থেকে পুরপ্রধান। একমনে ক্লাস করলেন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, পঞ্চায়েত প্রধান, ব্লক ও অঞ্চল কমিটির সভাপতিরাও।

বোলপুরের পুরমঞ্চে বৈঠকের পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি অনুব্রত। রবিবার দুপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।

বোলপুরের পুরমঞ্চে বৈঠকের পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি অনুব্রত। রবিবার দুপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।

অর্ঘ্য ঘোষ
বোলপুর শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৬ ০১:৫৭
Share: Save:

ক্লাস নিতে হাজির কড়া হেডমাস্টার। আর তাঁর দাপটে তটস্থ পড়ুয়ার দল!

রবিবার দুপুরে বোলপুর পুরসভার মঞ্চে ‘কেষ্টদার ক্লাস’-এর সাক্ষী হলেন জেলা তৃণমূলের বিভিন্ন স্তরের দু’শো নেতা। ক্লাসের শেষে মিলল বিশেষ ‘হোমওয়ার্ক’। দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ওই ক্লাসে ছিলেন সাংসদ, বিধায়ক থেকে পুরপ্রধান। একমনে ক্লাস করলেন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, পঞ্চায়েত প্রধান, ব্লক ও অঞ্চল কমিটির সভাপতিরাও। উপলক্ষ— আগামী ১৬ জানুয়ারি দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালীঘাটের বাড়ির বৈঠক। বীরভূমের নেতাদের নিয়ে হতে চলা ওই বৈঠকের রূপরেখা তৈরি করতেই এ দিন বসেছিল জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। সেখানেই দিদির সামনে কী বলা হবে আর কী বলা হবে না— সব কিছুই এ দিন স্পষ্ট করে দেন ‘কেষ্টদা’।

ঘটনা হল, বিধানসভা ভোটের আগে দলের জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করছেন মমতা। ইতিমধ্যেই পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, হাওড়া, হুগলি, নদিয়ার মতো বহু জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠক হয়ে গিয়েছে। সেখানে বারবারই দলের মধ্যে থাকা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথাই বারবার করে উঠে এসেছে। হুগলির সঙ্গে বৈঠকেই এক পুড়শুড়ার বিধায়ক পারভেজ রহমান এবং আরামবাগের সাংসদ অপরূপা পোদ্দারের উন্নয়নের টাকা খরচ করা নিয়ে তুমুল ঝগড়া বেধেছিল। একে অপরের বিরুদ্ধে আঙুল উঁচিয়ে কথাও বলেছিলেন তাঁরা। অপরূপা এক সময়ে কেঁদেই ফেলেছিলেন। গোটা ঘটনায় প্রবল ক্ষুব্ধ হন দলনেত্রী। এমনকী, দল থেকে বের করার হুঁশিয়ারিও দেন। সামনে বিধানসভা ভোট। তার আগে দলের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল করতে বৈঠকে দলের নেতাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগঠনের কাজ করতে বলেন মমতা।

আসন্ন ভোটের মুখে শুধু বৈঠকেই নয়, বিভিন্ন জেলা সফরে গিয়ে বারবার করে একই বার্তা দিতে দেখা যাচ্ছে তৃণমূলের দলনেত্রীকে। এই পরিস্থিতিতে বীরভূমের সঙ্গে দলনেত্রীর বৈঠকটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ হতে চলেছে বলেই রাজনৈতিক মহলের মত। কারণ, এই জেলায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। গত চার বছরে সেই দ্বন্দ্ব কোনও অংশেই কমেনি। বরং বহু ক্ষেত্রেই দলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের বলি হয়েছে নিচুতলার কর্মীরাই। চার বছরে জেলায় খুন হওয়া তৃণমূল নেতা-কর্মীর সংখ্যা কবেই দুই অঙ্ক ছাড়িয়েছে। দুবরাজপুরে জোড়া খুন থেকে দুই প্রাক্তন ব্লক সভাপতি অশোক ঘোষ এবং অশোক মুখোপাধ্যায়— সব ক্ষেত্রে নিশানায় শাসকদলেরই নিজেদের কোন্দল।

তবে, বর্তমানে জেলা তৃণমূল নেতৃত্বকে সব থেকে বেশি বেগ দিচ্ছে নানুর এলাকা। যেখানে কেতুগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজের ভাই কাজল শেখ এবং অনুব্রত ঘনিষ্ঠ স্থানীয় বিধায়ক গদাধর হাজরার বিরোধ প্রায় চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে। তার জেরে খোদ কাজলের উপরেই হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ। আর তার পর পরই বোলপুর এলাকায় খুন হয়ে যান গদাধর অনুগামী তিন তৃণমূল কর্মী। অথচ তার কিছু দিন আগেই শহিদ দিবসের মঞ্চে দলনেত্রীর বার্তা পেয়ে সমস্ত দ্বন্দ্ব ‘মিটিয়ে’ বোলপুর কার্যালয়ে এসে অনুব্রতর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন কাজল। আর তারই জেরে এ দিনই বৈঠক শেষে অনুব্রতকে এমনও বলতে হয়েছে, ওই এলাকায় গদাধরই ফের প্রার্থী হবেন। দলনেত্রী ছাড়া সেই সিদ্ধান্ত কেউ পাল্টাতে পারবেন না। অনুব্রত মুখে যা-ই বলুন না কেন, জেলায় শাসকদলের বিভিন্ন স্তরে যে নানা দ্বন্দ্ব এখনও বহাল, তা আড়ালে মানছেন বহু নেতা-কর্মীই।

তৃণমূল সূত্রের খবর, এত কিছুর পরেও বীরভূমে দলের অন্দরে কোথাও কোনও দ্বন্দ্ব নেই— বৈঠকে দিদির সামনে এমন ‘ছবি’ দেখাতেই এ দিন ক্লাস নিয়েছেন ‘দক্ষ সংগঠক’ অনুব্রত। সেখানেই অনুব্রত নিজে তিন ঘণ্টা ধরে ক্লাস নিয়ে আগামী বৈঠকের যাবতীয় ছক কষে দিয়েছেন। নেতাদের দিয়েছেন কড়া ‘হোমওয়ার্ক’। অন্যদের মতোই বাধ্য পড়ুয়ার মতো ওই ‘ক্লাস’ করেছেন সাংসদ শতাব্দী রায়, মন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, বিধায়ক মনিরুল ইসলামের মতো নেতারাও। কালীঘাটের বৈঠকের জন্য এ দিন প্রাথমিক ভাবে ২০০ জনের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। পরে কাঁটছাট করে সেখান থেকেই চূড়ান্ত তালিকা করা হবে। বৈঠকে থাকা ময়ূরেশ্বর ২ ব্লকের এক নেতা সতর্ক ভাবে বলেন, ‘‘কেষ্টদা কিন্তু প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছেন, এ দিনের বৈঠকের কথা বাইরে প্রকাশ করলেই দল থেকে বের করে দেওয়া হবে!’’ সাঁইথিয়া এলাকার এক যুব নেতা জানান, কেষ্টদা সাফ জানিয়েছেন, কালীঘাটে গিয়ে অনেক সতর্ক থাকতে হবে। বেফাঁস কিছুই বলা যাবে না। কথা বলবেন নির্দিষ্ট কিছু লোকই।

জেলায় তো বিরোধী বলতে প্রায় কিছুই নেই, তার পরেও কেন এত ‘চাপ’ নিতে দেখা যাচ্ছে অনুব্রতকে? এ দিনের বৈঠকে হাজির থাকা দলীয় নেতা-কর্মীদেরও মত, জেলার বিভিন্ন জায়গায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে দলে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। বাম দল থেকে আসা নেতাদের কর্তৃত্বে কোণঠাসা হয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন বহু আদি তৃণমূল নেতা-কর্মী। সিভিক পুলিশ থেকে প্রাথমিকের চাকরি নিয়ে দুনীতির অভিযোগও রয়েছে বিস্তর। মোটা টাকা দিয়ে ছেলের জন্য সিভিকের চাকরি কিনতে হয়েছে অনেক নেতাকেই। আবার টাকা দিয়েও অনেকে প্রাথমিকের চাকরি পাননি। পাননি সেই টাকা ফেরতও। অথচ প্রভাবশালীরা নিজের আত্মীয় স্বজনদের চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন। আবার নামে বেনামে ঠিকাদারি করে এই কয়েক বছরেই কিছু নেতা একাধিক ট্রাক্টর, মাটি কাটার যন্ত্র (‌ডোজার) কিনে প্রভাব খাটিয়ে ১০০ দিনের মতো নানা সরকারি প্রকল্পে টাকা কামিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন বলেও দলের বিভিন্ন স্তর থেকে নালিশ এসেছে। ‘বিক্ষুব্ধ’রা কেউ নেত্রীর সামনে বেমক্কা এই সব নিয়ে নালিশ না ঢুকে দেন— জেলার শীর্ষনেতাদের অনেকেই এই আশঙ্কায় ভুগছেন বলে মানছেন দলেরই একাংশের নেতা।

রামপুরহাট মহকুমা এলাকার এক ব্লক সভাপতির কথায়, ‘‘সামনেই ভোট। আমাদের অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। এই সব ছবি ধরা পড়লে দিদির কাছে প্রবল বকুনি খেতে হবে। তাই কেষ্টদা একটু হোমওয়ার্ক করে নিলেন আর কি!’’ নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে এ সব কিছুকেই ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন অনুব্রত। তাঁর দাবি, ‘‘আমাদের দলে কোনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নেই। কোনও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীও নেই। সংবাদমাধ্যমই আমাদের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী।’’

এই পরিস্থিতিতে জল মাপতে শুরু করেছে বামেরাও। ময়ূরেশ্বরে ষাটপলশায় আক্রান্ত হওয়ার পরে বেশ কয়েকটি বড় জাঠা বের করেছে সিপিএম। দু’ দিন আগেই বহু দিন পরে তৃণমূলের গড় বলে পরিচিত নানুর, শনিবার আবার ওই বিধানসভারই লাভপুরে— সফল ভাবেই জাঠা করতে তারা। তৃণমূলের এই সব প্রাক-নির্বাচনী প্রস্তুতি দেখে কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না দলের নেতারা। সিপিএমের জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদার প্রতিক্রিয়া, ‘‘যতই জল দিয়ে ধোওয়ার চেষ্টা করুন, কয়লার রং পাল্টাতে পারবেন না। তৃণমূলের নেতাদের প্রকৃত স্বরূপও মানুষ এখন বুঝতে পারছেন না। তাই তৃণমূলের সন্ত্রাসের পরোয়া না করেই মানুষ আমাদের জাঠায় যোগ দিচ্ছেন।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy