পিঠে অ্যাসিডে পোড়ার দাগ।—শুভ্র মিত্র
ছোট থেকেই গলায় গলায় বন্ধুত্ব। তারুণ্যে পা দিয়ে সেই জোড় আরও পোক্ত হয়ে উঠছিল। অ্যাসিডের ছিটে থেকে রক্ষা পাওয়া কলেজ ছাত্রীটি বিশ্বাসই করতে পারছেন না, নিজের সাধের কসমেটিক্স জোর করে তাকে দিয়ে দিত যে, কসমেটিক্সের শিশিতে ভরে সেই নিয়ে এসেছিল অ্যাসিড!
পুলিশ বলছে, তারই গায়ে ছিটানোর জন্য কলেজের পরীক্ষাগার থেকে অ্যাসিড চুরি করেছিল সে। মঙ্গলবার নিজের বাড়ির দাওয়ায় বসে ছাত্রীটি বলেন, ‘‘ভাবতেই পারছি না। ও কী করে এমনটা করতে পারে!’’
রবিবার বিকেলে ওই তিন কলেজ ছাত্রী কোতুলপুরে টিউশন নিয়ে জয়পুর ব্লকের গেলিয়া গ্রামের বাড়িতে ফিরছিলেন। বাস থেকে নামতেই দু’জনের গায়ে অ্যাসিড পড়ে। রক্ষা পেয়ে যান এক জন। স্থানীয় ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসার পরে দু’জনকেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। ঘটনার পরে বাস আটকে রেখেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু পুলিশ গিয়ে বাসে তল্লাশি করে একটি কসমেটিক্সের শিশি ছাড়া আর কিছু পায়নি।
সোমবার তিন বান্ধবীকে এক সঙ্গে বসিয়ে জেরা করে পুলিশ। তাতেই ভেঙে পড়েন এক জন। পুলিশের দাবি, তিনি স্বীকার করেছেন, এক তরুণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা বাড়িতে জানিয়ে দেওয়ায় এক জনের উপরে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অ্যাসিড ছেটাতে গিয়ে সমস্ত ওলটপালট হয়ে যায়।
শিশি উল্টে অ্যাসিড পড়ে তাঁরই হাতে। যাঁর গায়ে ছেটাতে চেয়েছিলেন, রক্ষা পেয়ে যায় সে। অ্যাসিড লেগে পাশে থাকা অন্য বান্ধবীর পিঠ এবং হাতের কিছুটা পুড়ে যায়।
মঙ্গলবার গেলিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, সন্দেহভাজন ছাত্রীটির বাড়ির দরজায় তালা ঝোলানো। ওই ছাত্রীর বাবা এলাকার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া মেলেনি। প্রতিবেশীরা জানান, সোমবার রাতেই পরিবারটি বাড়ি তালাবন্ধ করে চলে গিয়েছে। এলাকার বাসিন্দা অসীম খাঁ, নেপাল কৈবর্তরা বলেন, “মেয়েটা যে এমন কাণ্ড ঘটিয়ে বসবে ভাবতেই পারছি না।’’
ওই তিন তরুণী হুগলির বেঙ্গাইয়ের অঘোর কামিনী প্রকাশচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়েন। যাঁর পিঠে অ্যাসিড পড়েছে, তাঁর পড়াশোনার বিষয় পরিবেশবিদ্যা। যিনি অ্যাসিড ছুঁড়েছেন বলে পুলিশের অনুমান এবং যিনি অ্যাসিড থেকে রক্ষা পেয়েছেন—দু’জনই সাম্মানিক পুষ্টিবিজ্ঞানের ছাত্রী। পাস কোর্সের একটি বিষয় ছিল রসায়ন। পুলিশের দাবি, রসায়নের পরীক্ষাগার থেকেই অ্যাসিড চুরি করেছিলেন ছাত্রীটি।
অ্যাসিড থেকে রক্ষা পাওয়া ছাত্রীটি জানান, সম্প্রতি আঠারোয় পা দেওয়া ওই তরুণীর সঙ্গে কলেজের বাইরের এক যুবকের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বাড়িতে কথাচ্ছলে তা বলে ফেলেন তিনি। তার পরে তাঁর এক অভিভাবিকা সন্দেহভাজন তরুণীর অভিভাবকদের বিষয়টি বলে দেন। তার জেরে ওই তরুণী বাড়িতে বকুনি খায়।
ছাত্রীটি বলেন, ‘‘ও আমাকে খুব ভালবাসত। তবে সেই ঘটনার পরে আমাদের সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হয়।’’ কিন্তু তার থেকে যে এমন একটা ঘটনা ঘটে যাবে ভাবতেই পারেনি বলে জানান রক্ষা পাওয়া ছাত্রীটির। তাঁর দাবি, সপ্তাহ তিনেক আগে পরীক্ষাগারে কাজ করার সময় তাঁর অ্যাপ্রনে অ্যাসিড ছিটকে এসেছিল। তখন বুঝতে পারেননি কোথা থেকে অ্যাসিড এল। সেই সময় ঘটনাটিকে গুরুত্ব দেননি তিনি।
তবে এখন সে দিনের কথা মনে পড়েও সন্দেহ দানা বাঁধছে তাঁর মনে। ছাত্রীটি বলেন, ‘‘অ্যাসিড লেগে আমার তো বড় কোনও ক্ষতিও হতে পারত! আমি চাই ওর শাস্তি হোক।’’ যে অভিভাবিকা সন্দেহভাজন তরুণীর বাড়িতে তাঁর সম্পর্কের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন, এ দিন তিনি বলেন, ‘‘আমি তো ভালর জন্যই বলেছিলাম।’’
অ্যাসিড লেগে পিঠ এবং হাত পুড়েছে যে ছাত্রীর ঘটনার পড়ে মুষড়ে পড়েছেন তিনিও। বাড়িতে বসে ছাত্রীটি বলেন, ‘‘আমাদের তিন জনের বন্ধুত্ব সেই ছোটবেলা থেকে। সম্পর্কের কথা জানাজানি হওয়ার পরে অশান্তির মধ্যে ছিল, আমরা জানতাম। এত বড় একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলার আগে আমাদের কথা ভাবল না?’’ ওই ছাত্রীও অ্যাসিড হামলার জন্য শাস্তি চেয়েছেন তাঁর বন্ধুটির। তবে এ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। জেলা পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, “এখনও তদন্ত শেষ হয়নি। আমরা কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ করব।’’
কলেজের পরীক্ষাগার থেকে কী করে চুরি হল অ্যাসিড তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বেঙ্গাই কলেজের অধ্যক্ষ পরমার্থ ঘোষ বলেন, ‘‘আমি পুরো বিষয়টি জানি না। তবে যা শুনেছি তাতে খুবই অবাক হচ্ছি।’’
তিনি জানান, কলেজে কর্মীর অভাবে পরীক্ষাগারে কাজ করার সময় পড়ুয়াদের উপরে সর্বক্ষণ নজরদারি চালানো যায় না। তবে এই ঘটনার পরে সেই ব্যবস্থা আরও আঁটোসাঁটো করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy