তপ্ত দুপুরে বাড়ির ভিতরে একলা দাঁড়িয়ে মদনমোহন!
ভোট এসেছে বিষ্ণুপুরে। পথেঘাটে বেরোলে বৈশাখের পাশাপাশি নির্বাচনী আঁচও লাগছে গায়ে। কিন্তু সেখানে মদনমোহন, কেষ্ট রায়, শ্যাম রায়-রা নেই। অথচ বিশ্বের দরবারে বিষ্ণুপুরকে চেনাতে পারেন এঁরাই।
মদনমোহন, শ্যাম রায়-রা ভোটার নন। কিন্তু বিষ্ণুপুরের ভোটে এঁরা অদৃশ্য কেন, তা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির মন্দিরের অধিষ্ঠাতা দেবতা তো এঁরাই।
স্টেশন থেকে রাস্তায় পা রাখতেই রোদে ঝলসে গেল চোখমুখ। গরম হাওয়ায় চারপাশে পতপত করে উড়ছে তৃণমূলের পতাকা। দেওয়ালে দলীয় প্রার্থী সৌমিত্র খান। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একটু তফাতে রয়েছেন বামপ্রার্থী সুস্মিতা বাউরি, বিজেপি-র জয়ন্ত মণ্ডল। অলিতে-গলিতে ‘পুরনো চাল ভাতে বাড়ে’ স্লোগান নিয়ে কংগ্রেস প্রার্থী, আর এক খান নারায়ণচন্দ্র।
এক সময় বিষ্ণুপুর ছিল মল্ল রাজাদের রাজধানী। তাদের আমলেই গড়ে উঠেছিল পোড়ামাটির স্থাপত্য। ট্যুরিস্ট লজে দুপুরে খেতে বসে ভোটের কাজে আসা দুই সরকারি কর্তাও খোঁজ নিলেন টেরাকোটা মূর্তির দোকানপাট নিয়ে। শুধু টেরাকোটা নয়, বালুচরী শাড়ি, দশাবতার তাস, ধ্রুপদী সঙ্গীত এ সবের ঔজ্জ্বল্যেই ঝলমলে ছিল বিষ্ণুপুর। আর এখন? মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা পর্যটনের উন্নয়ন থমকে গিয়েছে। বালুচরী শিল্প কিংবা দশাবতার তাস ধুঁকছে।
কিন্তু ভোট যুদ্ধে তাদের নিয়ে প্রচার কই?
“থাকা উচিত ছিল।” মেনে নিলেন তৃণমূলের তরুণ তুর্কি সৌমিত্র। সাংসদ হলে এটা নিয়ে তিনি ভাববেন বলেও আশ্বাস দিলেন। বিষ্ণুপুরের উন্নয়ন, পর্যটন নিয়ে ভেবেছিলেন দু’বারের বাম সাংসদ সুস্মিতাদেবী। বললেন, “দিল্লিতে এ নিয়ে কথাও বলেছিলাম।” কিন্তু বিষয়টি যে আর এগোয়নি সে কথা বাম প্রার্থীর হাবেভাবেই পরিষ্কার। কংগ্রেসের নারায়ণবাবু দলীয় সভায় বিষ্ণুপুরের কথা বলছেন বটে। কিন্তু সে কথায় দিশা মিলছে কই! আদতে বিষ্ণুপুরের ভোট এ বার ঘুরপাক খাচ্ছে সন্ত্রাস আর গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের আবর্তে।
একদা বাম দুর্গ এই কেন্দ্রে বিরোধীদের সে ভাবে খুঁজেই পাওয়া যেত না। পাত্রসায়র, ইন্দাস, কোতুলপুরের গ্রামগুলিতে গাছের পাতা ছাড়া অন্য কিছুই সবুজ ছিল না প্রায়। গত লোকসভা ভোটে বাম-বিরোধী হাওয়ার মধ্যেও হইহই করে জিতেছিলেন সুস্মিতাদেবী। প্রায় ১২ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে। কিন্তু পরিবর্তনের বিধানসভায় আমূল বদলে যায় ছবিটা। সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে খণ্ডঘোষ বাদে ছ’টিই হাতছাড়া হয় বামেদের। ফলে এ বারের ভোটের আগে পাত্রসায়র, ইন্দাস, কোতুলপুরে বামেদের নিশান খুঁজে মিলছে না। যে দিকে তাকানো যায়, সে দিকেই জোড়া ফুলের রমরমা।
সেই রমরমার পিছনেই সন্ত্রাসের অভিযোগ আনছেন বামেরা। প্রচারে বেরিয়ে সুস্মিতাদেবী এ বার বড় সভা করছেনই না। রোজ সকালে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন এলাকা। ঢুকে পড়ছেন গ্রামের অন্দরে। পায়ে হেঁটে প্রচারের ফাঁকে খাওয়া সারছেন কোনও দলীয় কর্মীর দাওয়ায়। পাত্রসায়রের কেশবপুর গ্রামে এমনই এক দাওয়ায় দেখা মিলল তাঁর। সঙ্গে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ দে, জেলা ও জোনাল স্তরের নেতারা।
বামেদের অভিযোগ, গ্রামগুলিতে সমর্থকদের ভয় দেখানো হচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সন্ত্রাসের অভিযোগ পাচ্ছেন সুস্মিতাও। বলছেন, “মানুষ শান্তি চায়।” আর এই দাবি থেকেই জেতার হিসেব কষছেন তিনি। তবে সাবেক বাম দুর্গের গ্রামগুলিতে সিপিএমের নামগন্ধ আজ দৃশ্যত খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পার্টি অফিস তালা বন্ধ। গ্রামের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলে পারতপক্ষে এড়িয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ মুখ ফস্কে বলে ফেলছেন, “উরা এ দিকে মিছিল করে নাই।”
সন্ত্রাসের অভিযোগ তো আগেও ছিল। অভিযোগ ছিল লোকসভা হোক বা কলেজ ভোট, দাপিয়ে বেড়াতেন বাম সমর্থকেরা। কথাটা শুনে সুস্মিতাদেবীর আগেই মাথা নাড়লেন পাত্রসায়রের জোনাল সম্পাদক লালমোহন গোস্বামী (এলাকায় লালু গোঁসাই বলেই যার বেশি পরিচিতি)। বললেন, “আমরা কখনও এমন করিনি।”
সন্ত্রাসের অভিযোগ না হয় রইল। কিন্তু বিষ্ণুুপুরের টেরাকোটা মন্দির নিয়ে কী বলছেন বামেরা?
এ বারেও সুস্মিতাদেবীর আগে উত্তর দিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থবাবু। বললেন, “আমরা সাধারণ মানুষের অভাব-সমস্যা নিয়ে ভাবছি। এলাকায় অসংগঠিত শ্রমিকদের উন্নয়ন নিয়ে কথা বলছি।”
তৃণমূলের প্রচারেও সে ভাবে নেই মন্দির বা বালুচরী। ২০১১ সালে কোতুলপুর থেকে কংগ্রেসের টিকিটে জিতেছিলেন সৌমিত্র। ব্যবধান যদিও খুবই কম। তার পর তৃণমূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। রাজ্যসভা ভোটের আগে দলবদল এবং লোকসভার টিকিট। সেই যুদ্ধে লড়ার মুখে তাঁকে চিন্তায় রেখেছে দলীয় কোন্দল। তবে যুবক সৌমিত্রের শরীরে আত্মবিশ্বাস ভরপুর। ভোট লড়তে দুর্লভপুরের বাড়ি ছেড়ে বিষ্ণুপুরের একটি হোটেলে সদলবলে আস্তানা গেড়েছেন তিনি। দিনে-রাতে কেন্দ্রের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন। রাত এগারোটায় হোটেলে ফিরতে ধরা গেল তাঁকে।
গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ভোটে থাবা বসাবে?
প্রশ্নটা শুনেই ইতস্তত করলেন সৌমিত্র। বললেন, “ও ঠিক মিটে যাবে।” কোন্দল মেটাতে নিয়মিত বিভিন্ন গোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গে বসছেন প্রার্থী-জেলার নেতারা। কিন্তু কতটা মিটবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। সকাল ন’টায় ফকিরগঞ্জে মাজারে চাদর চড়াতে গিয়েছিলেন সৌমিত্র। ব্লক স্তরের এক নেতা দলবল নিয়ে এলেও অন্য নেতা অনুপস্থিত! কোতুলপুরের নতুন তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে বিবাদের জেরে পুরনোরা অনেকেই বসে গিয়েছেন। কর্মিসভাতেও সমর্থকদের ভিড় কম। এ সব দেখে সৌমিত্র ইষ্ট জপছেন, “এই সব ঝামেলার কোপ আমার ঘাড়ে যেন না পড়ে।”
ঘাড়ে পড়বে কি না, সেটা ইভিএমেই মালুম হবে। কিন্তু তার আগে এই ঝামেলার আবহে চাপা পড়ছে মল্লভূমের ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা। তৃণমূল প্রার্থীর মুখে শুধুই ‘দিদির পথে’ উন্নয়নের কথা।
কিন্তু ভোটারদের মধ্যে কি মন্দিরের সামনে পোড়ামাটির ঘোড়া-মূর্তি-গয়না সাজিয়ে বসা দোকানি কিংবা বালুচরী শাড়ি-বোনা তাঁতি পড়েন না? তাঁরা তো আশা করেন, পর্যটন আরও একটু চাঙ্গা হলে, আরও একটু সরকারি সাহায্য মিললে দু’পয়সা বেশি আয় হতো।
এ সব নিয়ে কি ভাবেন না ভোটপ্রার্থীরা?
“ভাবি তো! গ্রামে গ্রামে প্রচারে গিয়ে বলছিও।” বিজেপি প্রার্থী জয়ন্ত মণ্ডলের জবাব। কিন্তু তাঁর দেওয়াল প্রচারে সে কথা লেখা নেই! সে ভাবে জোরালো সংগঠন না থাকলেও মোদী হাওয়াটা তিরতির করে মালুম হচ্ছে বিষ্ণুপুরে। রামসাগরের মতো কিছু এলাকায় বিজেপির বাঁধা ভোটও আছে। সেই হাওয়াতেই ভর করে বাম-তৃণমূলকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ছেন জয়ন্তবাবু।
ভরদুপুরে ফের পোড়ামাটির মন্দির। সুনসান চত্বরে একা বসে বেসরকারি সংস্থার নিরাপত্তারক্ষী। চড়া রোদের দিকে নিষ্পলকে চেয়ে রয়েছে মন্দিরের দেওয়ালে খোদাই করে রাখা কোনও প্রেমিক যুগলের নাম। আর চেয়ে রয়েছেন মদনমোহন, শ্যাম রায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy