অবরোধ নয়। বাড়ছে যানবাহনের চাপ। কিন্তু বাইপাস রাস্তা হয়নি। তাই এটাই কোতুলপুরের রোজকার চিত্র। ছবি: শুভ্র মিত্র
মোঘল-পাঠানের লড়াইয়ের ইতিহাসের সাক্ষী কোতুলপুরের ছবি এখন অনেক বদলে গিয়েছে। চাষবাসে সমৃদ্ধ এই এলাকা জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জনবসতি। তাই জনপদও ছড়িয়ে পড়েছে। গাঁয়ের তকমা ঝেড়ে কোতুলপুর এখন শহর হিসেবে গড়ে উঠছে।
সেই সঙ্গেই নাগরিক চাহিদাও বাড়ছে। কিছু ক্ষেত্রে কাজ হলেও চাহিদা যে অনেক। তাই সে সব সমস্যা নিয়ে নাগরিক যন্ত্রণাও রয়েছে। বাঁকুড়া জেলার সীমান্ত লাগোয়া এই শহরের কাছেই হুগলির মহকুমা শহর আরামবাগ। আরামবাগ-বিষ্ণুপুর রাজ্য সড়ক কোতুলপুর শহরের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে। এই রাস্তাকে ঘিরেই দু’পাশে সারি সারি দোকান। কাজেই সেই সব দোকানে আসা ক্রেতাদের ভিড় ও তাঁদের সাইকেল, মোটরবাইকে রাস্তার অনেকখানি কার্যত বেদখল হয়ে যায়। ফলে রাস্তায় যান চলাচলের জায়গা কমে গিয়েছে। তাই দিনের প্রায় সব সময়েই যানজট পাকিয়ে থাকে এই রাস্তায়। আর এ নিয়েই দুর্ভোগে পড়েন যানবাহনের চালক থেকে কোতুলপুরের বাসিন্দারা। তাঁদের দাবি, শহর বাড়লেও নাগরিক পরিষেবা বৃদ্ধির দিকে প্রশাসনের নজর নেই।
তবে যানজটের অন্যতম কারণ বালিবাহী ট্রাকের অবাধ যাতায়াত। বাসিন্দাদের দাবি, দ্বারকেশ্বর নদ থেকে প্রতিদিন প্রায় ৬০০ ট্রাক বালি নিয়ে কোতুলপুরের ব্যস্ত এলাকা সিনেমাতলা থেকে নেতাজি মোড়ের উপর দিয়ে যাতায়াত করে। ফলে বাস ও অন্যান্য যানবাহনের সঙ্গে ট্রাকের যাতায়াত বেড়ে যাওয়ায় রাস্তা প্রায় গতিহীন হয়ে পড়ে। যানজটে নাকাল হয় বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রী, নিত্যযাত্রী ও বাসিন্দাদের।
কোতুলপুর চৌরাস্তা মোড়ের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক কর্মী মহিম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “যানজটের দুর্ভোগই এই শহরের প্রধান ব্যধি। বিশেষ করে বালির ট্রাকের যাতায়াতের জন্যই যানজট সমস্যা তীব্র হয়ে উঠেছে। বাইপাস রাস্তা করে ওই গাড়িগুলি চলাচলের ব্যবস্থা হলে দৈনন্দিন এই সমস্যা থেকে মুক্তি আমরা পাই।” শুকুলপাড়ার বাসিন্দা বধূ জয়ন্তী ঘোষেরও দাবি, “যানজটের জন্য বাজারে কেনাকাটা করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। রাস্তা পার হতে সময় লেগে যাচ্ছে। দুর্ঘটনারও ভয় থাকে। বাইপাস হলে এই সমস্যা কাটবে বলেই আমার ধারণা।” স্থানীয় বাসিন্দা তথা বিজেপির জেলা নেতা শিবদাস ঘোষও দাবি করেন, ‘‘কোতুলপুরের উত্তর দিকে মিলমোড় পর্যন্ত একটা বাইপাস রাস্তা গড়ার দাবি আমরা দীর্ঘদিন ধরে জানাচ্ছি। কিন্তু প্রশাসনিক উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না। যার ফলে যানজট সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করেছে। এ জন্য দুর্ঘটনাও বাড়ছে। প্রশাসনের তবু হেলদোল নেই।”
বাসিন্দাদের একাংশের অভিমত, বিবেকানন্দ ক্লাবের পাশ দিয়ে ভদ্র পাড়া ছুঁয়ে যে রাস্তাটি বিডিও অফিসের কাছে জয়রামবাটি যাওয়ার রাজ্য সড়কে গিয়ে মিশেছে, সেই রাস্তাটিকে সামান্য চওড়া ও পাকা করে বাইপাস হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। বাসিন্দাদের ক্ষোভ, সরকার আসে, সরকার যায়। কিন্তু তাঁদের এই দাবি নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই।
নাগরিকদের আরও একটি দাবি এখনও অবহেলিত— সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বড় সভাঘর। বাসিন্দাদের দাবি, এলাকায় সাংস্কৃতিক কন হয় না। কিন্তু সরকারি সভাঘর নেই। বাধ্য হয়ে স্কুল অথবা সিনেমা হলে অনুষ্ঠান করতে হয়। এলাকায় আবৃত্তি চর্চার একটি স্কুল চালান সতীনাথ চক্রবর্তী। তাঁর ক্ষোভ, “অনেক বছর ধরেই শুনছি এই ব্লক শহরে একটি কমিউনিটি হল তৈরি করা হবে। আমাদের সংস্থা থেকে বার্ষিক অনুষ্ঠান করি। ভেবেছিলাম, স্কুল বা সিনেমা হল ভাড়া না করে এ বার সরকারি হলে সেই অনুষ্ঠান করতে পারব। কিন্তু কোথায় কী! হচ্ছে হবে বলে কত বছর গড়িয়ে গেল, সরকারি হল তৈরি হল না।” সঙ্গীত শিল্পী পঞ্চানন দত্তের আক্ষেপ, এলাকায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে চর্চা বাড়বে। তাতে এলাকার পরিবেশ ভালো হবে। তিনি বলেন, “ভালো হল না থাকায় অনুষ্ঠানের আয়োজন কমে গিয়েছে। অথচ আশপাশের ব্লক শহরগুলোতে কমিউনিটি হল কবেই তৈরি হয়েছে। আমাদের কোতুলপুরকে কেন বঞ্চনা করা হচ্ছে জানি না।”
প্রশাসন সূত্রে অবশ্য জানানো হচ্ছে, উপযুক্ত জমি না পাওয়ায় কমিউনিটি হল নির্মাণের কাজটি আটকে রয়েছে। যদিও স্থানীয় বিবেকানন্দ ক্লাবের সদস্য সদানন্দ ভদ্র বলেন, “ভালো কাজের জন্য জমিজট কোনও সমস্যা নয়। আমাদের ক্লাবের ৬ একর জায়গা রয়েছে। সরকার চাইলে সে জমি দিতে আমরা রাজি।” কিন্তু এই টালবাহানা কেন? সরকারি বক্তব্য জানতে চেয়ে বিডিও-র অফিসে গিয়েও তাঁর দেখা মেলেনি। বারবার চেষ্টা করেও তাঁকে ফোনে ধরা যায়নি। কোতুলপুরের বিধায়ক শ্যামল সাঁতরা বলেন, “দু’টি সমস্যার কথাই আমি জানি। কমিউনিটি হলের জমিজট কেটে গিয়েছে। থানার পাশেই জেলা পরিষদের একটি উপযুক্ত জায়গা পাওয়া গিয়েছে। আশাকরি শীঘ্র ওই কাজ শুরু করা যাবে।” বাইপাস রাস্তা নিয়েও সরকারি স্তরে আলোচনা চলছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
ভ্রম সংশোধন
মঙ্গলবার এই সংস্করণে আমার শহর কোতুলপুর-এ ‘অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে মল্লরাজের কীর্তি’ শিরোনামটি ভুল প্রকাশ করা হয়েছে। বস্তুত কোতুলপুরের লাউগ্রামে মল্লরাজাদের প্রথম রাজধানী ছিল। তাঁদের তৈরি পুরাতাত্ত্বিক নির্দশন সে ভাবে ওই এলাকায় পাওয়া যায়নি। কিন্তু এখনও কোতুলপুরে রয়ে গিয়েছে ভদ্রবাড়ি-সহ আরও কয়েকটি পরিবারের তৈরি অসামান্য টেরাকোটার কাজ করা কিছু মন্দির। যা অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। এলাকায় ওই মন্দিরগুলি সংস্কারের দাবি রয়েছে। শিরোনাম হবে ‘অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে পুরাতাত্ত্বিক কীর্তি’। এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy