দেড়শো বছরে পা দেওয়া বাঁকুড়া শহর অনেকটাই বদলে গিয়েছে। গাঁ-গঞ্জ থেকে অনেকে উঠে এসে বাঁকুড়ায় ঘর বেঁধেছেন। নতুন নতুন পল্লি তৈরি হয়েছে। প্রখ্যাত ভাস্কর রামকিঙ্কর বেজের এই শহর বেড়েছে আড়ে-বহরে। কিন্তু রাস্তা বাড়েনি। বাঁকুড়ার ঘিঞ্জি রাস্তা আরও সঙ্কীর্ণ হয়েছে হকারদের দখলে চলে গিয়ে। ফলে রাস্তা নিশ্চিন্তে রাস্তা চলাচল করার উপায় নেই। বিশেষত শহরের প্রাণকেন্দ্র মাচানতলা এলাকায় শহরের গতি কার্যত থমকে গিয়েছে।
অথচ এই সব রাস্তা বেশ কয়েক বছর আগেও বেশ ফাঁক ছিল। আগে বাসও চলত শহরের ভিতর দিয়ে। এখন সেই সব দিনের কথা এই শহরের কম বয়েসিদের কাছে অলীক বলে মনে হতে পারে। শহরের যোগেশপল্লি এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা তথা প্রাক্তন সরকারি কর্মী সুধাময় ঘোষ বলেন, “আমাদের ছেলেবেলায় রাস্তা অনেক ফাঁক থাকত। রাস্তার পাশে দোকান থাকলেও রাস্তা দখল করে পসরা নিয়ে দোকানিরা বসতেন না। কয়েক দশক আগে থেকেই ছবিটা ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে। মাচানতলা, চকবাজার এলাকায় কিছু হকার বসলেও আশির দশকেও এতটা সমস্যা ছিল না। আমরা নির্বিঘ্নেই রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে যেতে পারতাম।” কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে হকারদের রাস্তা দখল করে ব্যবসা করার প্রবণতা বাড়তে থাকে। প্রবীণদের মতে, এর পিছনে রাজনৈতিক নেতাদের মদত ছিল।
বেশ কয়েক বছর আগে শহরের রাস্তা হকারদের দখল থেকে মুক্ত করতে পথে নেমেছিলেন তদানীন্তন জেলাশাসক রীনা ভেঙ্কটরামন। রাস্তার ধারে বে-আইনি দখলদারি রুখতে তিনি যে সাহসী পদক্ষেপ করেছিলেন তা আজও ভুলতে পারেননি জেলার মানুষ। প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি শহরের বেশ কিছু এলাকায় রাস্তা দখল মুক্ত করেন। রাজনৈতিক শক্তি প্রতিবাদে সরব হয়। তাঁকে অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়। মুষ্ঠিমেয় কিছু লোকের রোষানলে তিনি পড়লেও আপামর বাঁকুড়াবাসীর কাছে তিনি ‘লেডি বুলডোজার’ নাম পেয়ে যান। এখনও শহরের বিভিন্ন আড্ডায় তাঁর সুখ্যাতি শোনা যায়। অনেকে দুঃখ করে বলেন, তিনি আরও কিছু দিন থাকলে হয়তো শহরটার ভোল বদলে দিতেন।
কিন্তু তা হয়নি। ধীরে ধীরে বাঁকুড়া শহরের রাস্তা কমতে কমতে আরও ছোট হয়ে গিয়েছে। মাচানতলা, চকবাজার, সুভাষরোড থেকে লালবাজার, কেরানিবাঁধ, স্টেশন রোড একে একে বেদখল হয়ে যাচ্ছে। শুধু হকাররাই নয়, স্থায়ী দোকানের মালপত্রও অনেক জায়গায় দোকানের বাইরে নামিয়ে রাখা হচ্ছে। তাতে নাকি ক্রেতাদের আরও আকর্ষণ করা যায়! এ দিকে যাত্রী সাধারণের যে ভিড়ে ঠাসা সঙ্কীর্ণ রাস্তা পারাপার করতে আবস্থা কাহিল হয়ে পড়ছে, সে দিকে নজর নেই। পুজো, ঈদ থেকে চৈত্র সেল শহরের রাস্তায় ভিড় আরও উপচে পড়ে। সেই সঙ্গে হকারদের রাস্তায় মালপত্র নামিয়ে হাঁকডারও বেড়ে যায়। তখন পুরবাসীর যন্ত্রণা আরও বেড়ে যায়।
রানিগঞ্জ মোড়ের বাসিন্দা কবি অবনী নাগ বলেন, “হকারদের বে-আইনি ভাবে রাস্তা দখল করে ব্যবসা করায় মদত দিতেন কিছু রাজনৈতিক নেতা। শহরকে তাঁরা ভালবাসেননি, তাঁরা রাজনৈতিক স্বার্থটুকুই ভাবতেন। রীনাদেবী নিজের মতো করে শহরটাকে সাজাতে চেয়েছিলেন। রাজনৈতিক চাপের কাছে মাথা নোয়াননি বলেই তাঁকে বদলি হয়ে যেতে হল। আমাদের শহরটাও যে কে সেই রয়ে গেল।”
পরবর্তী কালে হকারদের হাত থেকে রাস্তা মুক্ত করতে যাঁরাই পদক্ষেপ করতে গিয়েছেন, তাঁদের উপরেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে রাজনৈতিক চাপ এসে পড়েছে। পুরসভায় ক্ষমতায় আসার পরে বেশ কয়েকবার পুরপ্রধান শম্পা দরিপাকে হকার উচ্ছেদে নামতে দেখা গিয়েছে। তিনি যতবারই অভিযান চালিয়েছেন তাঁর দলেরই একাংশ তাতে আপত্তি তুলেছে। গত বছর ২০১২ সালে জেলাশাসক বিজয় ভারতী পুলিশ বাহিনী নিয়ে শহরের মাচানতলা এলাকায় হকার উচ্ছেদ অভিযানে নেমেছিলেন। ভেঙে দিয়েছিলেন কিছু ঝুপড়ি দোকান। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই মাচানতলার সেই পুরনো ছবিটা আবার ফিরে আসে। শহরের মানুষ এ বার চাইছেন স্থায়ী সমাধান। কিন্তু তা কি আদৌ হবে? লাখ টাকার প্রশ্ন। সামনেই পুরভোট। শাসক-বিরোধী সব দলই এখন তাই হকার-ভোট হারাতে নারাজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy