লোকসভা ভোটের পর থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন জেলার সঙ্গে বাঁকুড়া জেলাতেও তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বার বার প্রকাশ্যে এসেছে। এই জেলায় প্রায় প্রতিটি ব্লকেই কমবেশি এই সমস্যা চলছে। তবে জেলা নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠেছে পাত্রসায়র ও গঙ্গাজলঘাটি ব্লক। ওই দুই জায়গায় একাধিকবার প্রকাশ্যেই শাসকদলের এক পক্ষের নেতা অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। পাত্রসায়রে মারপিটও হচ্ছে।
রাজ্যজুড়ে তৃণমূলের এই অভ্যন্তরীণ সঙ্কট কাটাতে আগেই কড়াবার্তা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার তাঁর সুরেই গলা মেলালেন বাঁকুড়ার জেলা নেতারাও। সোমবার বাঁকুড়ার রবীন্দ্রভবনে ২১শে জুলাইয়ের প্রস্তুতি সভায় জেলা সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী বলেন, “বাইরের দল থেকে কিছু বেনো জল আমাদের দলে ঢুকে কর্মীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন আমরা সভাধিপতি, এমএলএ বা এমপি যাই হই না কেন, আমরা কিন্তু আদপে তৃণমূল কর্মী। আমাদের সবাইকে একসঙ্গে মিলে কাজ করতে হবে।”
ঘটনাচক্রে অরূপবাবু যখন এই বক্তব্য রাখছেন তখন মঞ্চেই উপস্থিত ছিলেন লোকসভা ভোটের মাসখানেক আগে কংগ্রেসের বিধায়ক পদ ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়ে সাংসদ হওয়া সৌমিত্র খা।ঁ তিনি বর্তমানে যুব তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের মুখ শুভেন্দু আধিকারীকে সরিয়ে যুব সভাপতির পদে সৌমিত্রকে বসিয়েছেন মমতা। তা নিয়েও শীর্ষ তৃণমূলের অন্দরে কম জলঘোলা হয়নি। গঙ্গাজলঘাটির বাসিন্দা এই সৌমিত্র জেলা রাজনীতিতে অরূপবাবুর বিরোধী মেরুতে অবস্থান করেন বলেই পরিচিত। কাজেই এই বক্তব্যের মাধ্যমে অরূপবাবু তাঁকেই নিশানা করছেন কী না তা নিয়েও দলের একাংশের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে। যদিও তৃণমূলের জেলা নেতারা অবশ্য কোনও বিতর্কে যেতেই নারাজ। তাঁদের মতে, অরূপবাবু সামগ্রিক ভাবে নব্য তৃণমূল কর্মীদের নিয়েই এই কথা বলেছেন। তিনি কোনও ভাবেই সৌমিত্রকে উদ্দেশ করে এই মন্তব্য করেননি। যাঁকে নিয়ে জল্পনা, গঙ্গাজলঘাটির ছেলে সেই সৌমিত্র বলেন, “এ রকম কোনও কথা বলা হয়েছে বলে তো শুনিনি!” অরূপবাবু নিজেও এ দিন সন্ধ্যায় দাবি করেছেন, “আমি নির্দিষ্ট ভাবে কাউকে ওই মন্তব্য করিনি। আমি বলতে চেয়েছি সিপিএম ছেড়ে অনেকে আমাদের দলে এসেছেন। তাঁরাই বেনোজল। কর্মীদের সেই লোকেদের থেকে সতর্ক থাকতে ওই মন্তব্য করেছি।”
লোকসভা ভোটের নিরিখে বিজেপি রাজ্যে প্রধান বিরোধী শক্তি হয়ে ওঠার পর থেকে সিপিএম থেকে তো বটেই, জেলার কয়েকটি এলাকায় তৃণমূলের বিক্ষুদ্ধ কর্মীরাও বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন। বাঁকুড়া থানার যে মুনিয়াডিহি গ্রামে বিজেপি-তৃণমূল সংঘর্ষের ঘটনাকে ঘিরে অরূপ চক্রবর্তীর বিতর্কিত মন্তব্যে হইচই পড়ে যায়, সেখানেও কিছু বিক্ষুদ্ধ তৃণমূল কর্মী বিজেপিতে আগে যোগ দিয়েছিলেন। কাজেই দলের শক্তি ধরে রাখতে শীর্ষ নেতৃত্ব এখন পুরনো কর্মীদের আঁকড়ে ধরতে চাইছেন বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল।
কিন্তু নব্য তৃণমূলীরা দলে ভারী হওয়ায় ক্ষোভ যে শুধু কর্মীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তা নয়। একই রকম ক্ষোভ রয়েছে নেতাদের মনের মধ্যেও। যুব তৃণমূলের রাজ্য নেতা সুব্রত দরিপা-র কথাতেই তা পরিষ্কার। মঞ্চে তিনি দাবি করেন, “যাঁরা পুরনো তৃণমূল কর্মী, তাঁরা দলে যোগ্য সম্মান পাচ্ছেন না। যাঁরা বিভিন্ন দল ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন, তাঁরা দলে বড় মর্যাদা পাচ্ছেন। এরফলে পুরসভা, বিধানসভা, লোকসভা সব জয় করেও আমাদের পুরনো তৃণমূল কর্মীদের মনে শান্তি নেই।” দলের বিভিন্ন নেতাকে এ ভাবে মুখ খুলতে দেখে কিছু পুরনো তৃণমূল কর্মীর মন্তব্য, “বিজেপি-র শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় শীর্ষ নেতৃত্ব এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন, যে ভোট বৈতরণী পার হতে কঠিন সময়ে পুরনো কর্মীরাই ‘ভাঙা কুলো’। তাই ২০১১-র বিধানসভা ভোটের পর থেকে বেনো জল দলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কোণঠাসা করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন আগামী ভোটগুলোয় শক্তি বজায় রাখা কঠিন বুঝতে পেরে আমাদের আবার বুকে টানতে চাইছেন নেতারা।”
দলের যুব সংগঠনের নতুন সভাপতি সৌমিত্র অবশ্য সবাইকে নিয়ে চলার পক্ষপাতী। এ দিন সভার শেষ লগ্নে নিজের বক্তব্যেও সৌমিত্রবাবু যুব কর্মীদের সতর্ক করে দেন, “মনে রাখবেন আমরা কিন্তু ছোট। আমাদের উপরে অনেক বর্ষীয়ান নেতা রয়েছেন। সময়ে অসময়ে কোনও সমস্যায় পড়লে তাঁদের পরামর্শ নিয়েই আমাদের এগোতে হবে।” এ দিন বক্তব্যে ফের সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন সৌমিত্রবাবু। তিনি বলেন, “সিপিএম বা বিজেপি নয়, মিডিয়াই আমাদের প্রধান শত্রু। যখন কোনও বিষয়ে ঘরোয়া আলোচনা হয় তখন অনেকেই অনেক কথা বলে ফেলেন। কেউ মোবাইলে সেই সব রেকর্ডিং করতে যাবেন না। পরে মিডিয়ার হাতে সেই রেকর্ডিং গেলে তারা অপপ্রচারে নামবে।” ওই সভায় ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-সহ জেলার তৃণমূল বিধায়কেরা।
এ দিনের কর্মিসভায় দেখা ছিলেন সোনামুখীর বিধায়ক দীপালি সাহা-ও। লোকসভা নির্বাচনের সময় ছাপ্পা ভোট করানোর অভিযুক্ত শাসক দলের এই বিধায়ককে জামিন পাওয়ার পরে এই প্রথম জেলার কোনও বড় মাপের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দেখা গেল। তিনি কোনও বক্তব্য পেশ করেননি।
ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। রবীন্দ্রভবনে জায়গা না পেয়ে বহু তৃণমূল কর্মী ভবনের বাইরে দাঁড়িয়েও সভা শুনেছেন। অন্য জেলায় যুব তৃণমূলের বিগত কয়েকটি সভায় কর্মীদের হাজিরা কম হওয়ায় বাঁকুড়ার কর্মিসভা ভরাতে খানিকটা চাপেই ছিলেন এই জেলার যুব নেতারা। এ দিন অবশ্য ভিড়ে ঠাসা সভা দেখে সৌমিত্রবাবু বলেন, “বাঁকুড়ার যুব নেতৃত্ব কতটা শক্তিশালী তা এই ভিড় প্রমাণ করছে।” জেলার যুব তৃণমূল সভাপতি শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই এই সভাকে ঘিরে তাঁরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তা সফলও হল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy