আদ্রার মণিপুরের হোমে ভাইফোঁটা। —নিজস্ব চিত্র।
কেউ কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত পরিবারের সন্তান বলে সমাজ থেকে পরিত্যক্ত। কেউ বা অনাথ। আবার অনেকে কোনওকারণে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল, এখন ফেরার পথ বন্ধ।
আদ্রা লাগোয়া মণিপুর গ্রামের অরুণোদয় শিশু নিকেতন হোমে ঠাঁই হওয়া সেই সব বালক-বালিকার জীবন থেকে উৎসবের সব রং অবশ্য মুছে যায়নি। শনিবার হোমের মেয়েরা ছোট ছোট ভাইদের কপালে ফোঁটা দিয়ে যমের দুয়ারে কাঁটা দিলেন। ফোঁটা দিলেন এলাকার আরও কয়েকজন দিদি-বোন। ফোঁটা নিলেন পুলিশ-প্রশাসনের আধিকারিকরাও। অনুষ্ঠান শেষে রঘুনাথপুরের এসডিপিও পিনাকী দত্ত তাই বলতে বাধ্য হয়েছেন, “সম্পূর্ন ভিন্ন স্বাদের একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পেরে সত্যিই খুব ভালো লাগছে।”
হোমের সম্পাদক নবকুমার দাস জানান, এখানে সকলেই অনাত্মীয়। কিন্তু সকলে মিলেই একটি পরিবার। সবার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। ভাইফোঁটার দিনে এদের মধ্যে সেই সম্পর্কটা আরও মজবুত করতে, প্রয়োজনে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা তৈরি করতে ভাইফোঁটার আয়োজন করা হয়। শুরুটা কয়েকবছর আগে থেকে হলেও এ বার একটু বড়মাপের আয়োজন করা হয়। নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল পুলিশ, প্রশাসনের কর্তাদেরও।
এই হোমটি পরিচালনা করে মণিপুর কুষ্ঠ পুনর্বাসন কেন্দ্র নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। মূলত কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত পরিবারগুলির ছেলেমেয়েদের পুনর্বাসনের উদ্দেশেই আশির দশকে এই অরুণোদয় শিশু নিকেতনের পথ চলা শুরু হয়। কিন্তু বর্তমানে এই হোমে রয়েছে অনাথ ছেলেমেয়ে থেকে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা ছেলেমেয়েরাও। সব মিলিয়ে হোমে এখন আবাসিকের সংখ্যা প্রায় ১৫০। তাদের মধ্যে ৩৭ জন মেয়ে।
শনিবার ভাইফোঁটার দিনে এই মেয়েদের সঙ্গে গ্রামের আরও প্রায় ১৮ জন মেয়ে ফোঁটা দিয়েছেন ‘অনাত্মীয়’ ভাইদের। উপস্থিত ছিলেন জেলা সমাজ কল্যাণ দফতরের আধিকারিক নীলিমা দাস, জেলা শিশু সুরক্ষা আধিকারিক অমিয় সূত্রধর, আদ্রার ওসি পঙ্কজ সিংহ প্রমুখ। নীলিমা দেবী বলেন, “ছোটখাটো অনুষ্ঠান হলেও এই দিনটার তাৎপর্য অনেক। ওদের বলেছি, বড় হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরে যেন ওদের এই ভাই-বোনের বন্ধন নষ্ট না হয়। একে অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।”
গত দশ বছর ধরে ভাইফোঁটার দিনে হোমের মেয়েরা ফোঁটা দিয়ে আসছে। “এমনিতে হোমের মেয়েরা নিজেরাই আগে থেকে নিজের ভাই হিসেবে একেক জনকে বেছে নেয়। বছরভর তাদের ভাই-বোনের মতই সম্পর্ক থাকে। আর এই বিশেষ দিনে তা যেন আরও মধুর হয়ে ওঠে।” বলছিলেন নবকুমারবাবু। দীর্ঘদিন হোমে থাকা স্থানীয় হাইস্কুলের ছাত্রী টুইঙ্কল খন্না, অনিতা মাহাতো, রিয়া রজক, লক্ষ্মী মাজিরা শনিবার তাদের বেছে নেওয়া ভাইদের কপালে ফোঁটা দিয়েছে। টুইঙ্কল, লক্ষ্মীদের কথায় “দীর্ঘদিন ধরে পরিবারের সাথে সে ভাবে যোগাযোগ নেই। তা ছাড়া বাড়িতে ভাই নেই। অনেকদিন ধরে একসাথে থাকতে-থাকতে এখানেই ভাইদের খুঁজে পাই। প্রতি বছর এই দিনটার জন্য অপেক্ষায় থাকি।”
ফোঁটা নিয়ে প্রশান্ত মান্ডি, শঙ্কর আনসারিদের প্রতিক্রিয়া, “এই হোমেই আমরা আমাদের পরিবারকে খুঁজে পেয়েছি। তাই ভাইফোঁটার দিনে আলাদা একটা ভালোলাগা থাকে।” আবার বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে পুরুলিয়ায় উদ্ধার হয়ে মণিপুরের হোমে ঠাঁই মেলা উত্তরপ্রদেশের হরিচরণ চাকী বা শিবমদের কথায়, “বাড়িতে ভাইফোঁটা বলে কিছু ছিল না। কিন্তু এখানে এসে অনেক বোনদের কাছে ফোঁটা পেয়ে অন্যরকম একটা আনন্দ হচ্ছে।” বস্তুত দীর্ঘদিন ধরে এক সাথে থাকার ফলে পরিবার, সমাজ থেকে পরিত্যক্ত ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে সহজাত ভাবে ভাইবোনের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় বলেই এই ভাইফোঁটার অনুষ্ঠানটি ওরা এত উপভোগ করে বলে বলে অভিমত শিশু সুরক্ষা দফতরের আধিকারিক অমিয় সূত্রধরের।
তবে শুধু মুখে কি ভাইফোঁটা হয়? ফোঁটা দেওয়ার সময়েই ভাইদের মিষ্টিমুখ করিয়েছে বোনেরা। দুপুরে জমিয়ে খাওয়া দাওয়াও হয়েছে। পাতে পড়ে ভাত, ডাল, পাঁচমেশালি তরকারি, মুরগির মাংস, চাটনি, মিষ্টি। নবকুমারবাবু জানান, ভাইফোঁটার দিনে তারা দৈনন্দিন খাবারের বদলে সাধ্যমতো একটু ভালো খাবারের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া এসডিপিও মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন। আর সমাজকল্যাণ আধিকারিক চকোলেট ও বিস্কুট এনেছিলেন। সব মিলিয়ে শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এই হোমেই ঘর খুঁজে ফেলেন ঘর-হারানো ছেলেমেয়েরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy