নাচে-গানে জমিয়ে দিলেন শিল্পীরা। মঙ্গলবার মুকুটমণিপুরে অভিজিৎ সিংহের তোলা ছবি।
কেউ বললেন ‘খেঁদির বিয়েতে ব্যান্ড পার্টি’, আবার কারও কথায় ‘এক বেলার পেট পুজো’! কেউ কেউ বনের মাঝেই হতবাক!
লোকসংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে শিল্পীদের নিয়ে বাঁকুড়া জেলাপরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত একদিনের মেলা ও বনভোজনকে নিয়ে এভাবেই কটাক্ষ করতে শোনা গেল উপস্থিত শিল্পীদের অনেককে। শিল্পীরাই জানতেন না, তাঁদের কেন তলব করা হয়েছে। ঘটনা হল, সরকারি খাতায় শিল্পী হিসেবে নাম তোলাতে কোথায় যেতে হবে, তা নিয়ে অনুষ্ঠানের শেষেও বহু শিল্পীর ধোঁয়াশা কাটল না।
মঙ্গলবার জেলার অন্যতম পর্যটনক্ষেত্র মুকুটমণিপুরে জঙ্গলমহলের চারটি ব্লকের প্রায় ১০ হাজার আদিবাসী লোকশিল্পীকে নিয়ে একটি বনভোজনের আয়োজন করেছিল জেলা পরিষদ। সম্প্রতি মেজিয়া বই মেলা উদ্বোধন উপলক্ষে জেলায় আসা বাঁকুড়ার সাংসদ মুনমুন সেনকে জঙ্গলমহলের মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসার বিষয়ে প্রথম থেকেই উদ্যোগী হয়েছিলেন জেলা সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী। জেলা পরিষদ সূত্রে খবর, মুনমুনের জেলায় আসার কথা পাকা হওয়ার পরেই অরূপবাবু এই বনভোজনের কথা ঘোষণা করেন। তৃণমূল নেতাদের একাংশের বক্তব্য, লোকসভা ভোটের প্রচারে গিয়ে জঙ্গলমহলের মানুষের কাছে মুনমুনকে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন অরূপবাবু।
জেলা পরিষদের নিজস্ব তহবিল থেকেই এই অনুষ্ঠানের জন্য লক্ষাধিক টাকা বরাদ্দ হয়েছে বলে প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে। বেছে বেছে জঙ্গলমহলের চারটি ব্লকে সহ দক্ষিণ বাঁকুড়ার আদিবাসী লোকশিল্পীদের এই বনভোজনে ডাকা হয়। মুকুটমণিপুরের পুলিশ ফাঁড়ির মাঠে একটি মঞ্চ গড়া হয়। একটু বেলা গড়াতেই সেই মঞ্চের সামনে মাঠে শতাধিক আদিবাসী নৃত্য দল ধামসা মাদল বাজিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করে। দুপুর প্রায় দু’টো নাগাদ অরূপবাবু সাংসদ মুনমুনকে নিয়ে মঞ্চে আসেন। তারপরই মাঠে নৃত্যরত আদিবাসী দলগুলিকে নাচ বন্ধ করতে বলে শুরু হয় কর্তা ব্যক্তিদের বক্তৃতা।
মঞ্চটিকে সরকারি মঞ্চ বলে ঘোষণা করেও আদিবাসী শিল্পীদের উদ্দেশ্যে অরূপবাবু বলেন, “আমাদের দলের বিরুদ্ধে মিথ্যা কুসা রটাচ্ছে বিরোধীরা। কিন্তু আপনারা প্রমান করে দিলেন যে জঙ্গলমহলের মানুষ আমাদের পাশেই আছে। এই ভিড় তারই প্রমান। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে মুনমুন নিজেকে আদিবাসী গৃহবধূ বলে দাবি করে বলেন, “দূরে বসে অনেক কথাই বলতে পারে। কিন্তু আপনাদের পাশে একজনই রয়েছেন, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।”
শিল্পীদের জন্য গড়া রাজ্য সরকারের প্রকল্পের কথা বলার জন্য অরূপবাবু জেলা তথায় সংস্কৃতি আধিকারিক গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়কে বক্তব্য রাখতে বলেন। গৌতমবাবু তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে প্রকল্পের সুবিধাগুলি শিল্পীদের কাছে তুলে ধরেছেন। বক্তব্য শেষ হলে অরূপবাবু মেলার সমাপ্তি ঘোষণা করে শিল্পীদের বনভোজনের জন্য যেতে বলেন।
কি বলছেন বনভোজনে আসা শিল্পীরা?
মঞ্চের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে সারেঙ্গা থেকে মেলায় আসা শৈলেন হাসদা, সুকমল হাঁসদারা জানান, শিল্পীদের জন্য যে সরকারি প্রকল্প রয়েছে তা তাঁরা জানতেন না। এখানে তা নিয়ে বিশেষ আলোচনাও হল না। তাঁরা বলেন, “শিল্পী হিসেবে সরকারের খাতায় নাম তুলতে আমরা কোথায় যাব কিছুই বুঝতে পারলাম না।”
শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সোমবারই পঞ্চায়েত সমিতি থেকে ফোন করে তাঁদের মুকুটমণিপুরে এসে অনুষ্ঠান করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের মঞ্চে উঠে অনুষ্ঠানও করতে দেওয়া হয়নি। তাঁদের অভিযোগ, “আমাদের খিচুড়ি খাইয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে বলা হচ্ছে।” সরকারি প্রকল্পের আওতায় আসতে কোথায় যেতে হবে তা নিয়ে একই রকম ধোঁয়াশায় সিমলাপাল থেকে আসা অমর টুডু, ইন্দ্র সরেনদের মতন অনেকেই।
বনভোজন কেমন লাগছে জানতে চাওয়া হলে রানিবাঁধ ব্লকের একটি আদিবাসী নৃত্য দলের মহিলারা বলেন, “গ্রামে ১২ মাস জলের সংকট, চাষ-বাস হয় না এ বছরেও, সংসারে রোজ ভাত জোটানো দায়। এই সব বনভোজনে কি আমাদের সমস্যা মিটবে?”
ঘটনা হল, সম্প্রতি কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রশাসনিক বৈঠকে বাঁকুড়া জেলা পরিষদের কাজের অগ্রগতি নিয়ে অখুশি হন মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠকে অরূপবাবুকে কাজের অগ্রগতি বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দেন। আর তারপরও এ দিনের বনভোজন!
যার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে জেলা পরিষদের বিরোধী দল নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “পুরো অনুষ্ঠানটির জন্য জেলা পরিষদের নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত খরচ কতটা হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। বাজেটে এই ধরনের বনভোজনের কথা বলা ছিল না। স্থায়ী সমিতির বৈঠকে এই অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা হতে শুনিনি। জেলা পরিষদের এই টাকা উন্নয়নে লাগানো যেতে পারত।” অরূপবাবুর অবশ্য দাবি, “বনভোজনের খরচ আমাদের কর্মাধ্যক্ষরা ব্যক্তিগতভাবে দিয়েছি। জেলা পরিষদের টাকায় শুধু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy