ইতিহাস আঁকড়ে রয়েছে বহুলাড়ার মন্দির। ছবি: অভিজিৎ সিংহ
স্থাপত্যের চূড়া আকাশ ছুঁয়ে আজও দাঁড়িয়ে, যা চমক দেয় সাধারণ মানুষকে। তবে ইতিহাস এখন কালের গর্ভে। প্রায় ৫০২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গঠিত বাঁকুড়ার ওন্দা ব্লকের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে অসামান্য সব স্থাপত্য। তবে ইতিহাস মাটির তলায় চাপা।
সোনাতপল, বহুলাড়া, হরিহরপুরের মতো ওন্দা ব্লকের ছোট ছোট গ্রামে যে সব সৌধগুলি রয়েছে, তার প্রকৃত নির্মাণকাল কত, তা নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা রয়েছে। কারা এই স্থাপত্যগুলি গড়েছিলেন, তার উত্তর এখনও অজানা। এই ইতিহাসের খোঁজে নেমে অনেকেরই জীবন পার হয়ে গিয়েছে। অনেকে এখনও তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে বহু প্রশ্নের কিনারা হয়নি। ইতিহাসের অনালোকিত অধ্যায় নিয়ে রয়ে গিয়েছে নানা বিতর্ক।
নানা সূত্র ধরে ইতিহাসবিদরা জানাচ্ছেন, এই সব স্থাপত্য যখন গড়ে উঠেছিল, বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের তখন কোনও অস্তিত্বই ছিল না। অনুমান হিন্দু-জৈন যুগে এইসব নির্মাণ কাজ হয়েছিল। জৈনরাই এই সব সৌধ তৈরি করেছিলেন। আবার ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, এই সব নির্মাণ বৌদ্ধ স্থাপত্যের নিদর্শন।
তাঁদের মতে, বহুলাড়ার সিদ্ধেশ্বর শিবের মন্দিরের কারুকাজ মল্লরাজাদের স্থাপত্য শৈলিকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। মন্দিরটির সারা গায়ে অলঙ্করণ। ওড়িশার রেখ দেউলের সাদৃশ্যে গঠিত এই মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ১৯.২ মিটার। মন্দিরের ভিতরে শিবলিঙ্গ ছাড়াও, বহু প্রাচীন গণেশ, মহিষ-মর্দিনী ও পার্শ্বনাথের মূর্তি রয়েছে। বর্তমানে এই মন্দিরটির নাম সিদ্ধেশ্বর শিবের মন্দির। এখানে প্রতি বছর গাজন উৎসব পালিত হয়। তবে এই মন্দিরটি একসময় জৈনরাই স্থাপন করেছিল বলে মত রয়েছে। মন্দিরের পাশে খোঁড়াখুঁড়ি করে বেশ কয়েকটি স্তূপ পাওয়া গিয়েছে। এই স্তূপগুলি দেখেই তা প্রমাণ হয়।
ওন্দার ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে যাচ্ছেন বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজের অধ্যাপক অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, “এই স্তূপগুলি আদপে জৈন পণ্ডিত ও শ্রাবকদের সমাধি (চৈত)। দ্বারকেশ্বর নদের পারে বর্তমান ওন্দা ব্লকে সেই সময় জৈনদের বসতি ছিল। এখানের অধিকাংশ স্থাপত্যই তাদের হাতে গড়া।” আনুমানিক একাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এই স্থাপত্য নির্মিত হয়েছিল বলেই মত গবেষকদের। মন্দিরটির নির্মাণ কী ভাবে হয়েছিল তা নিয়েও অবশ্য কিছু গ্রামবাসীর মধ্যে একটি জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে। গ্রামের যুবক কিশোর বাউরির কথায়, “আমার দাদুর কাছে শুনেছি, এলাকার অনেক বয়স্ক লোকেরাও বলেন দৈব কারণে নিজে নিজেই এই মন্দির সৃষ্টি হয়েছিল।”
ওন্দার সোনাতপলের সূর্যমন্দিরটিও বহু প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী। ইটের তৈরি বিশাল এই রখ দেউলটিও জেলার অন্যতম পুরাকীর্তি। ইতিহাসবিদ তরুণদেব ভট্টাচার্য তাঁর বাঁকুড়া গ্রন্থে লিখেছেন, সোনাতপল গ্রামের প্রাচীন নাম হামিরডাঙা। মন্দিরটির নির্মানকাল এগারো শতকে। জনশ্রুতি শালিবাহণ নামের কোনও এক রাজা এই মন্দিরটি স্থাপন করেছিলেন। তৎকালীন হামিরডাঙায় শাকদ্বীপি ব্রাম্ভ্রণদের বাস ছিল। তাঁরা সূর্যের উপাসনা করতেন। যদিও অরবিন্দবাবুর কথায়, “জনশ্রুতির মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি শালিবাহণ নামের এক রাজা ছিলেন। কিন্তু ওন্দার কোথাও সেই রাজার কোনও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে সূর্যমন্দিরটিও যে জৈন স্থাপত্য এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।”
সোনাতপলের মন্দিরও দৃষ্টিনন্দন। কিন্তু আলপথই ভরসা।
একই ভাবে ওন্দা ব্লকের হরিহরপুরেও বেশ কিছু প্রাচীন মন্দিরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। মন্দিরগুলির শৈলিতে জৈন স্থাপত্যের ছাপ পাওয়া যায়। তবে এই সব মন্দিরে এখন শিবের উপাসনা চলছে। উল্লেখ্য, সূর্য মন্দির ও বহুলাড়ার সিদ্ধেশ্বর শিবের মন্দির বহু প্রাচীন ও রাজ্য সরকারের পুরাকীর্তি বিভাগের সংরক্ষিত। তা সত্ত্বেও দু’টি মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষনে নানা খামতি দেখা যাচ্ছে। বাসিন্দাদেরও এ নিয়ে কম অভিযোগ নেই। কয়েকবছর আগে সংস্কার করা সূর্যমন্দিরটির গায়ে গজিয়ে উঠেছে গাছ। মন্দিরটি যাওয়ার পথও ভালো নয়। আলপথ পেরিয়ে এই মন্দির দেকথে যেতে হয়। এই মন্দিরের পূজারী ষষ্ঠী মল্লের ক্ষোভ, “অনেকেই মন্দির দেখতে আসেন। গ্রামে আসার রাস্তাটি লালমাটির। কিন্তু মন্দির দেখতে জমির আলপথ মাড়িয়ে যেতে হয়। সে কারণে অনেকে দূর থেকেই মন্দির দেখে ফিরে যান। সরকার সচেষ্ট হলে এই মন্দিরটিকে ঘিরে গ্রামটিকে একটি পর্যটন স্থল হিসেবেও গড়া যেতে পারে।”
অন্য দিকে, বহুলাড়ার মন্দিরটিতে কোনও বাতি না থাকায় বিকেলের পরে বহু পর্যটকই এসে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ওন্দার বিডিও শুভঙ্কর ভট্টাচার্য অবশ্য সমস্যাগুলি সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় সোনাতপল যাওয়ার পাকা রাস্তা তৈরির কথা হয়েছে। বহুলাড়ার মন্দিরেও বৈদ্যুতিক বাতি বসানোর বিষয়ে আমি জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি।”
ইতিহাসের হাত ধরে এই সব এলাকা কি ভবিষ্যতের পর্যটন স্থান হিসেবে উঠে আসবে? জবাব দেবে আগামী দিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy