Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

কফিনেই শাঁখা ভাঙলেন বাবলুর স্ত্রী

কোথায় কফিন? সকাল গড়াল বিকেলে। তবু দেখা নেই কফিনবন্দি দেহের। ঠায় অপেক্ষা। কিন্তু কোথাও কোনও বিশৃঙ্খলা নেই।

ছেলের কফিনের সামনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বনমালাদেবীকে। নিজস্ব চিত্র

ছেলের কফিনের সামনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বনমালাদেবীকে। নিজস্ব চিত্র

নুরুল আবসার ও সুব্রত জানা
বাউড়িয়া শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৩:২৩
Share: Save:

সকাল থেকেই জমছিল ভিড়টা।

৮ থেকে ৮০— কে নেই সেই ভিড়ে! বেলা যত বাড়ছিল, পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল ভিড়ের বহর। হাজার হাজার মানুষ। হাতে জাতীয় পতাকা। সকলে একবার চান কফিনটা ছুঁতে।

কিন্তু কোথায় কফিন? সকাল গড়াল বিকেলে। তবু দেখা নেই কফিনবন্দি দেহের। ঠায় অপেক্ষা। কিন্তু কোথাও কোনও বিশৃঙ্খলা নেই। সর্বত্র শোকের ছায়া। বাড়িতে বাড়িতে উঠছে জাতীয় পতাকা। এ তল্লাটের অনেক বাড়িতেই এ দিন রান্না হয়নি। এলাকা কার্যত বন্‌ধের চেহারায়। খোলেনি দোকান-বাজার।

শেষ-বিদায়: সন্ধে সাড়ে ৬টা। রাজবংশীপাড়ায় এসে পৌঁছল বাবলু সাঁতরার কফিনবন্দি দেহ। নিজস্ব চিত্র

শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নাগাদ বাউড়িয়ার চককাশী রাজবংশীপাড়ায় পৌঁছয় পুলওয়ামায় জঙ্গি হানায় নিহত বাবলু সাঁতরার কফিনবন্দি দেহ। ভিড় সামাল দিতে আগে থেকেই ব্যবস্থা নিয়েছিল পুলিশ প্রশাসন। গোটা এলাকা মুড়ে ফেলা হয়েছিল কড়া নিরাপত্তায়। বাবলুর বাড়ির সামনের মাঠে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। ভিড় যাতে আছড়ে পড়তে না-পারে, তার জন্য মাঠ ঘেরা হয়েছিল বাঁশের ব্যারিকেডে। কফিন পৌঁছনো মাত্র সেই ব্যারিকেডেই আছড়ে পড়ল ভিড়। সেই ভিড়ে ছিলেন বাউড়িয়ার পালপাড়ার সত্তর বছরের তুষ্টচরণ পাল। সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রায় চার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে এসেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘অকালে চলে গেল ছেলেটা। একবার শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসব না!’’

অবসরের আর এক বছর বাকি ছিল বছর ঊনচল্লিশের বাবলুর। এ বছর ছুটিতে এসে তাঁর নতুন বাড়ি রং করার কথা ছিল। কিন্তু আগেই চলে গেলেন চির-ছুটিতে। বাড়িতে রেখে গেলেন তাঁর বৃদ্ধা মা বনমালাদেবী, স্ত্রী মিতা এবং ছ’বছরের মেয়ে পিয়ালকে। এ দিন সর্বত্র শুধু বাবলুকে নিয়েই আলোচনা। সকাল থেকেই ক্ষণে ক্ষণে রাজবংশীপাড়ায় শোনা গিয়েছে, ‘বাবলু সাঁতরা অমর রহে’। দোষীদের শাস্তির দাবিও উঠেছে ঘনঘন।

ভিড় উপচে পড়েছে এলাকায়। স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের ছাদে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব বয়সের মানুষ। নিজস্ব চিত্র

কফিন রাজবংশীপাড়ায় পৌঁছতেই সেই স্লোগান আরও তীব্র হল। ছেলের কফিনে প্রথমে মালা দিতে আসেন বনমালাদেবী। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়েন। দু’টি হাত আকাশের দিকে তুলে আপন মনেই বলে চলেন, ‘‘আমার কী হবে! আমার কী হবে!’’ এর পরে আসেন বাবলুর স্ত্রী মিতা। সালোয়ার-কামিজের উপরে কালো চাদরে অর্ধেক মুখ ঢাকা। পায়ে জুতো নেই। কোনও মতে এসে কফিনে মাথা ঠোকেন তিনি। কফিনেই ধাক্কা মেরে ভাঙেন দু’হাতের শাঁখা। ছ’বছরের পিয়াল তখন তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে। চারপাশে যা হচ্ছে, তা বোঝার বয়স হয়নি মেয়েটির।

বাবলুর কফিনের সঙ্গে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। রাজবংশীপাড়ায় আসেন বিজেপি নেতা রাহুল সিংহ, মন্ত্রী অরূপ রায়, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, কংগ্রেস বিধায়ক অসিত মিত্র। ছিলেন জেলা পুলিশ প্রশাসনের কর্তারা। সকলের মালা দেওয়ার পরে সিআরপিএফের তরফে ‘গান স্যালুট’ দেওয়া হয়। সারা মাঠ তখন নিস্তব্ধ। অনেকের চোখে জল। চোখের জলেই বিদায় ‘ঘরের ছেলে’কে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE