জলপাইগুড়ি রাজবাড়ির বিসর্জনে ভিড়। নিজস্ব চিত্র
দায় কার? শারদোৎসবে কোভিড বিধি ভঙ্গ নিয়ে এটাই মূল প্রশ্ন।
অতিমারি পরিস্থিতিতেও শারদোৎসবে ভিড় উপচে পড়েছে। পথেঘাটে, মণ্ডপে অঞ্জলি, সিঁদুরখেলায় কোভিড বিধি শিকেয় উঠেছে। পুজোয় এ –ওকে টেক্কা দেওয়ার খেলা যেমন চলেছে, পুজো কমিটিগুলির মধ্যে, তেমনই জেলা থেকে কলকাতা— পুজো দেখতে মরিয়া, নিয়মভাঙা জনতা ঝাঁপিয়ে পড়েছে, পুলিশের সামনেই। এই নিয়ম ভাঙার উৎসবের দায় প্রশাসন এড়াতে পারে কি না, সেই প্রশ্নও জনমানসে উঠেছে। অনেকেই বলছেন, নাইট কার্ফু তুলে দেওয়া, পক্ষান্তরে পুজো দেখতে উৎসাহিত করার ফলেই লোকজন পথেঘাটে বেরিয়েছেন। প্রশাসনের মনোভাব এ বার মোটেও কড়া ছিল না। বরং পুজো থেকে বিসর্জন, মাস্কহীন ভিড়ের সামনে কার্যত অসহায় দেখিয়েছে উর্দিধারীদের।
প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে নবান্নের শীর্ষ কর্তারা সরাসরি মুখ খুলতে নারাজ। তবে তাঁদের একাংশের পর্যবেক্ষণ, আদালত আগের বছরের বিধি কার্যকর থাকার কথা জানালেও মনোভাবে ‘তেমন কড়া ভাব’ ফুটে ওঠেনি। প্রায় দেড় বছর অতিমারি পরিস্থিতির ফলে এবং অনেকেই টিকার একটি ডোজ় পাওয়ায় ভয়ভীতি ভুলে উদ্বাহু হয়ে উৎসবে মেতেছেন। পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের দাবি, উৎসবে রাস্তায় জনতার ঢল নামলে কিছুই করার থাকে না। তখন কড়া হাতে মোকাবিলা করতে গেলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হবে। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারত। কলকাতা পুলিশের কর্তাদের মতে, সরকারি বিধি বলবৎ করার পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধিতেও জোর দেওয়া হয়েছিল। কয়েকটি পুজো মণ্ডপকে ঘিরে সাধারণ মানুষের আগ্রহ থাকায় শহরের কিছু এলাকায় ভিড় জমেছিল।
পুজোর ক’দিনে বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল লেকটাউনের শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব। সেখানে বুর্জ খলিফার আদলে ১৪৫ ফুট উঁচু মণ্ডপের সামনে বেপরোয়া ভিড় হয়েছে। বিমানবন্দর এলাকায় নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে লেজ়ার ব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছয় যে অষ্টমীর রাত থেকে ওই মণ্ডপে দর্শক ঢোকা বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। কিন্তু কার্যত তৃতীয়া থেকে ওই পুজোয় যে ভিড় হয়েছে এবং যে ভাবে নিয়মের তোয়াক্কা না-করে উৎসব পালন হয়েছে তার দায় কার উপরে বর্তায়, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
২০০৯ সালে কলকাতা হাই কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, মণ্ডপের সর্বোচ্চ উচ্চতা (সুপার স্ট্রাকচার-সহ) ৪০ ফুটের বেশি করা যাবে না। দমকলের কাছ থেকে পুজোর অনুমতি নেওয়ার সময় নিয়ম মেনে মণ্ডপ করা হবে, এই ঘোষণাও করতে হয়। অথচ খোদ দমকলমন্ত্রী সুজিত বসুর পুজো কী ভাবে ১৪৫ ফুটের মণ্ডপের অনুমতি পেল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটেছেন দমকলকর্তারা। তবে তাঁরা মেনে নিচ্ছেন, দমকলের ল্যাডার দিয়ে সর্বোচ্চ ১৫০ ফুট পর্যন্ত জল দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেই গাড়ি শ্রীভূমির গলিতে ঢুকতে পারত না। আর মন্ত্রী বলছেন, ‘‘আনন্দের উৎসবকে বিতর্কে জড়িয়ে নিরানন্দে পরিণত না-করাই বাঞ্ছনীয়। তবে কলকাতায় অনেকেই ১০০ ফুটের বেশি মণ্ডপ তৈরি করেছে।’’ প্রশ্ন ওঠে, হাই কোর্টের নির্দেশ ভেঙে উঁচু মণ্ডপ করার কথা জানলেও দমকলমন্ত্রী কলকাতার ওই পুজোগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি কেন? প্রসঙ্গত, কলকাতায় সব পুজো কাঁটায় কাঁটায় নিয়ম মেনে করে এমন নয়। অনেকেই ‘প্রভাব’ খাটিয়ে নির্দিষ্ট উচ্চতার বাড়তি মণ্ডপ করে।
প্রশ্ন ওঠে, পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও। শ্রীভূমি নিয়ম ভেঙে মণ্ডপ তৈরি করলেও বিধাননগর পুলিশের পরিদর্শনে তা ধরা পড়ল না কেন? কেন ভিড় সামলাতে আগেভাগেই প্রশাসন মণ্ডপ করার সিদ্ধান্ত নিল না? প্রশাসনের খবর, অষ্টমীর সন্ধ্যায় খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীর সঙ্গে কথা বলেন। তার পরে রাজ্য পুলিশের ডিজি মারফত জ্ঞানবন্ত সিংহের কাছে নির্দেশ যায়। এডিজি পদের এই অফিসার বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার পদে ছিলেন। তিনিই পরিদর্শন করে দর্শকের প্রবেশ বন্ধ করার পরামর্শ দেন। যদিও সূত্রের দাবি, দর্শক প্রবেশ বন্ধ করার প্রস্তাব প্রথমে মেনে নেননি পুজো উদ্যোক্তারা। সামনের বছর সুবর্ণ জয়ন্তী, এই কারণ দেখিয়ে দর্শক আগমন চালু রাখতে চান। কিন্তু শেষমেশ পুলিশের সঙ্গে আলোচনায় বসে রাত পৌনে ১১টা নাগাদ দর্শকের প্রবেশ বন্ধ করা হয়।
তবে তৃতীয়া থেকে বাঁধনছাড়া ভিড় হলেও সিদ্ধান্ত নিতে কেন অষ্টমী গড়িয়ে গেল? অনেকেই মনে করছেন, পুজো নিয়ে হাই কোর্টে মামলা রয়েছে। তাই প্রশাসন যে কড়া মনোভাব নিয়েছে সেটা প্রমাণ করতেই মন্ত্রীর পুজোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করেছে নবান্ন। কিন্তু শুধু একটি পুজোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপই কি যথেষ্ট? প্রশ্নটা থাকছেই।
গত বছর কলকাতা হাই কোর্ট অতিমারি পরিস্থিতিতে উৎসব পালনের বিধি আরোপ করেছিল। এ বছর কার্যত সেই বিধি জারি রেখেছে আদালত। তাতে মণ্ডপে প্রবেশে নিষেধ ছিল, সিঁদুর খেলা এবং অঞ্জলিতে যোগ দেওয়ার নিয়মও বলা হয়েছিল। মণ্ডপে দর্শক প্রবেশ না-করলেও কলকাতা-সহ রাজ্যের বহু পুজোতেই অঞ্জলি এবং সিঁদুর খেলায় নিয়মের তোয়াক্কা না-করেই ভিড় হয়েছে। শুধু তাই নয়, মণ্ডপের দ্বার বন্ধ করলেও ঘুরপথে ভিড় জমানোর পথে হেঁটেছে বহু পুজো কমিটি। প্রকাশ্যে না-বললেও ঘনিষ্ঠ মহলে ভিড় টানার লড়াইয়ের কথা স্বীকারও করেছেন পুজো কর্তাদের অনেকে। অনেকেই বলছেন, হাই কোর্ট কয়েকটি বিধির কথা বললেও নির্দেশের মূল বিষয় নিহিত ছিল জমায়েতে রাশ টানায়। বিধি পালনের নিয়মরক্ষাটুকু হলেও ভিড় এড়ানোর নৈতিক চেষ্টা কি পুজো কর্তারা করেছেন? বেশির ভাগ পুজোকর্তাই নিয়ম মেনে ‘যথাসাধ্য’ চেষ্টার কথা বলছেন। বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা শ্রীভূমি স্পোর্টিংয়ের পুজো কর্তা দিব্যেন্দু গোস্বামীর দাবি, তাঁদের দায়বদ্ধতায় কোনও খামতি ছিল না। যদিও জগৎ মুখার্জী পার্ক পুজোর কর্তা দ্বৈপায়ন রায় মনে করেন, ‘‘পুজো কমিটিগুলি দায় অস্বীকার করতে পারে না।’’ ওই পুজোর অদূরেই কুমোরটুলির একটি পুজোয় দেখা গিয়েছে, মণ্ডপের প্রবেশ দ্বার বন্ধ থাকলেও ঠাকুর দেখার জন্য এক দিক উন্মুক্ত করা ছিল। সেখানেই থিকথিকে ভিড় জমেছে, মাস্কহীন মুখে উঠেছে ছবিও। আবার শ্রীভূমির পুজোয় দর্শক প্রবেশ বন্ধ হলেও শনিবারও দেখা গিয়েছে, সেখানে ইতিউতি ভিড় জমেছে। সকলেই ‘পাড়ার লোক’!
সব শেষে প্রশ্ন ওঠে, আমজনতাও কি দায় এড়াতে পারে? নিজেদের স্বার্থেই সুবুদ্ধির প্রমাণ দেওয়ার পরিচয় ছিল। কিন্তু বোধন থেকে বিসর্জন, জনতার ঢলে তার প্রমাণ মেলেনি বললেই চলে। বিসর্জনে কোচবিহার থেকে উত্তরপাড়া, সর্বত্রই ‘বাঁধনহারা’ ভিড় হয়েছে। চলেছে মাস্ক না-পরেই নাচানাচি। এই ভিড়ের মনোভাব পূর্ব বর্ধমানের কালনায় একটি বিসর্জনের শোভাযাত্রায় যোগ দিতে আসা পূর্ণিমা ঘোষ, মধুসূদন মুখোপাধ্যায়দের বক্তব্যেই তা স্পষ্ট। তাঁরা বললেন, ‘‘টিকার দু’টি ডোজ় নেওয়া আছে। তাই ভয় না পেয়ে চুটিয়ে আনন্দ করছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy