—প্রতীকী ছবি।
কোথাও ব্লাড ব্যাঙ্কটাই বন্ধ। কোথাও আবার ব্যাঙ্কে রক্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও রিক্যুইজিশন জমা নেওয়া হয়নি। কোথাও আবার রোগীকে বাঁচাতে মরিয়া পরিবারের লোকেরা দাতা জোগাড় করে ব্লাড ব্যাঙ্কে নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেখান থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কর্মী নেই। তাই রক্ত নেওয়া যাবে না। টানা পুজোর ছুটিতে ‘রোগের ছুটি’ না হলে যে কী ভোগান্তি পোহাতে হয়, এ বারও তা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন অসংখ্য রোগী।
কার্যত ষষ্ঠী থেকেই যাবতীয় পরিষেবায় অঘোষিত ছুটি শুরু হয়েছিল সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে। রোগীরা ভর্তি হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সামান্য চিকিৎসাটুকু পেতেও তাঁরা নাস্তানাবুদ হয়েছেন। আর এরই মধ্যে সব চেয়ে বেশি সমস্যা হয়েছে রক্ত পেতে। ডেঙ্গি রোগী উপচে পড়েছে হাসপাতালে। অথচ প্লেটলেট অমিল। ক্যানসার, থ্যালাসেমিয়া, হিমোফিলিয়া রোগীরা রক্তের অভাবে প্রবল ভোগান্তিতে পড়েছেন। হাহাকার চলেছে বিভিন্ন হাসপাতালে।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, আর জি কর, এসএসকেএম, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে পুজোর ক’দিন কোনও রক্তদান শিবির ছিল না। নীলরতন সরকারে অষ্টমী আর দশমীতে দু’টি শিবির হয়েছে। সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কে সপ্তমীতে চারটি শিবির ছিল। কিন্তু তার মধ্যে তিনটিতেই রক্তের উপাদান বিভাজনের কাজ হয়নি। নবমীতে উদ্যোক্তারাই বাতিল করে দেন একটি শিবির। দশমীতে দু’টি শিবির হয়েছে, কিন্তু উপাদান বিভাজন হয়নি। স্বাস্থ্যকর্তারা স্বীকার করেছেন, রাজ্য জুড়ে রক্তের যা চাহিদা ছিল, তার ২০ ভাগও পূরণ করা যায়নি।
‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ভলান্টারি ব্লাড ডোনার্স ফোরাম’-এর সাধারণ সম্পাদক অপূর্ব ঘোষ বলেন, ‘‘পুজোর চার দিন প্রতি মুহূর্তে ফোন এসেছে। বহু মানুষ কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন, রক্ত দরকার। আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কিছুই করতে পারিনি। পুজোর ছুটিতে কার্যত স্বাস্থ্য পরিষেবাও ছুটিতে চলে গিয়েছিল। শুধু ডেঙ্গি রোগী নয়, প্রচুর ক্যানসার রোগীও রক্ত পাননি।’’
একই অভিজ্ঞতা রক্তদান আন্দোলনের কর্মী শুভঙ্কর চৌধুরীর। তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘‘রোগীদের যে কী ভয়াবহ পুজো কেটেছে এ বার, তা ভাবা যায় না। কোনও কোনও সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত থাকা সত্ত্বেও রিক্যুইজিশন জমা নেওয়া হয়নি। কোথাও আবার রক্ত নেই বলে রোগীকে বাঁচানোর জন্য পরিবারের লোকেরা দাতা জোগাড় করে এনেছেন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। কারণ সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক জানিয়ে দিয়েছে, তারা রক্ত নিতে পারবে না। লোক নেই। তাই বাধ্য হয়ে ছুটতে হয়েছে বেসরকারি ব্যাঙ্কে।’’
কিন্তু শুধু কি সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক? বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কেও মানুষের নাকানিচোবানি খাওয়ার ছবি। সিঙ্গল ডোনার প্লেটলেট প্রয়োজন ছিল এক ডেঙ্গি রোগীর। ঢাকুরিয়ার একটি হাসপাতালে দাতা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্ক জানায়, বিকেল চারটের পরে দাতার কাছ থেকে রক্ত নেওয়া সম্ভব নয়। বিকেলে ব্লাড ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকবে।
ব্লাড ব্যাঙ্কের মতো একটি জরুরি পরিষেবা, যা বছরে ৩৬৫ দিন ২৪ ঘণ্টাই খোলা রাখার কথা, সেটা কী ভাবে বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব? হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের কাছে তার কোনও জবাব ছিল না।
ঠিক যেমন জবাব ছিল না বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্ক কী ভাবে সপ্তমী থেকে দশমী টানা চার দিন বন্ধ থাকতে পারে, সেই প্রশ্নেরও। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, ব্লাড ব্যাঙ্কের রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত কিছু কাজকর্ম চলছিল। তাই বন্ধ রাখা হয়। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, পুজোর সময়ে যেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে মানুষের আতান্তরে পড়ার ভয় সব চেয়ে বেশি, সেখানে রক্তের মতো জীবনদায়ী জিনিস নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কী ভাবে? সেই প্রশ্নের কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্মীরা জানিয়েছেন, শুধু দুর্গাপুজোর চার দিনই নয়, কালীপুজোতেও তাঁদের ব্লাড ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকার কথা।
তা হলে কি যে কোনও উৎসবের মরসুমে এ ভাবে অসহায় ভাবে বিভিন্ন দরজায় ঠোক্কর খাওয়াটাই রোগীদের একমাত্র ভবিতব্য? রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর আক্ষেপ, ‘‘এমনটা হওয়া কোনও ভাবেই কাম্য নয়। আমি বিস্তারিত খোঁজখবর নিচ্ছি।’’
স্বাস্থ্য দফতরের অতিরিক্ত সচিব পৃথা সরকার বলেন, ‘‘এই সমস্যা যাতে না হয়, সে জন্য আগেই আমরা নির্দেশিকা জারি করেছিলাম। কোথাও লোকবলের অভাব থাকার কথা নয়। কোনও রোগীকে যাতে রক্তের জন্য ফিরতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে আমরা চেষ্টা চালিয়েছি। কিন্তু বিপুল জনসংখ্যার কারণে হয়তো সব সময়ে ১০০ শতাংশ সফল হওয়া যায় না। তবু আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy