প্রতীকী চিত্র।
রোগ লুকোলে নিজেরই ক্ষতি। ব্যক্তি-মানুষের ক্ষেত্রে যেমন, রাজ্যের ক্ষেত্রেও এটা সমান সত্যি। তবু ডেঙ্গির তথ্য নিয়ে ঢাকঢাক-গুড়গুড় কেন? যা বোঝা যায়, তা বলা কেন বারণ?
রাজ্যে ডেঙ্গি-তথ্য নিয়ে, ডেঙ্গিতে মৃত্যুর সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে এমনই প্রশ্ন, এমনই আক্ষেপ ঝরে পড়ছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের গলায়। সেই আক্ষেপে কার্যত সিলমোহর লাগিয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক পদস্থ কর্তা জানিয়ে দিচ্ছেন, ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণে রাজ্যের স্বাস্থ্য ভবনের অবস্থান তাঁদেরও বোধের বাইরে!
স্বাস্থ্য দফতরের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজ্যে ডেঙ্গিতে মৃতের সংখ্যা ২৭। আক্রান্ত ৪৪,৮৫২। বিধানসভাতেও সেই তথ্য পেশ করা হয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, স্বাস্থ্য ভবন অক্টোবরের শেষে জানিয়েছিল, মৃতের সংখ্যা ২৩। তার পরে শুধু ১৭-২৫ নভেম্বরের মধ্যেই ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে অন্তত ছ’জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। মৃতের তালিকায় নাম রয়েছে অহর্ষি ধর (৩), সুনিধি শর্মা (৫) আজিজুল হক (৩৩), ফারুক মণ্ডল (৩২), সোনু চৌধুরী (২৪) এবং শ্রীনা খাতুনের (২৬)। এই ছ’টি মৃত্যু যুক্ত হলে মৃতের সংখ্যা আরও বেশি হওয়া উচিত। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, এ বছর জ্বরে প্রাণহানির বিভিন্ন ঘটনায় মৃত্যুর কারণ ডেঙ্গি কি না, তা নির্ধারণে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। চিকিৎসা সংক্রান্ত নথি খতিয়ে দেখে সম্মতির সিলমোহর দিচ্ছে কমিটি। এই প্রক্রিয়ায় এখনও পর্যন্ত অনেক মৃত্যুর কারণ যাচাই করা সম্ভব হয়নি বলে জানাচ্ছে স্বাস্থ্য ভবন।
স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা অমিয় হাটি বলেন, ‘‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা রয়েছে, সম্ভাব্য ডেঙ্গি হলেও ডেঙ্গি বলেই চিহ্নিত করতে হবে। সে-ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণও ডেঙ্গি লিখতে হবে।’’ ইন্ডিয়ান পাবলিক হেল্থ অ্যাসোসিয়েশনের জেনারেল সেক্রেটারি সঙ্ঘমিত্রা ঘোষ বলেন, ‘‘ডেঙ্গিতে মৃত্যু কি না, তা যাচাইয়ের দরকার কী! আর কোনও রোগের ক্ষেত্রে তো এমন হয় না। এটা গন্ডগোলের বিষয় মনে হতেই পারে।’’
গন্ডগোলের অবশ্য কিছু দেখছেন না বিশেষজ্ঞ কমিটির এক সদস্য-চিকিৎসক। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথমে ডেঙ্গিতে মৃত্যুর সম্ভাবনা খারিজ হয়ে গিয়েছিল। পরে চিকিৎসার নথি দেখে ডেঙ্গিতেই মৃত্যু বলে মত দিয়েছি, এমনও ঘটেছে। ডেঙ্গি বলা যাবে না, এমন কোনও নির্দেশও নেই।’’
ডেঙ্গির পরিসংখ্যান নিয়ে স্বাস্থ্য ভবনের অবস্থানে রাজ্যেরই ক্ষতি হচ্ছে বলে জনস্বাস্থ্য প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকদের একাংশের অভিমত। সম্প্রতি দিল্লিতে ডেঙ্গি নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক মানের সম্মেলন হয়ে গেল। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ এবং সাউথ ইস্ট এশিয়া রিজিয়নের (ডব্লিউএইচও) উদ্যোগে সেই সম্মেলনে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরের ডেঙ্গি বিশেষজ্ঞেরা ছিলেন। এ রাজ্যে জনস্বাস্থ্য প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘এমন একটি মঞ্চে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব হয়নি। কারণ, নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিভিন্ন দেশ থেকে যাবতীয় পরিসংখ্যান পায়। পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রকে ডেঙ্গির তথ্য দেয় না। ফলে খাতায়-কলমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও ধারণা হল, এ রাজ্যে ডেঙ্গি নেই!’’
এক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পর্যবেক্ষণ, পশ্চিমবঙ্গ ডেঙ্গি নিয়ে ‘ডকুমেন্ট’ তৈরি করার মতো প্রচুর কাজ করেছে। এখানে চিকিৎসার যে-প্রোটোকল হয়েছে, তা বেশ ভাল। কোন দেশে ডেঙ্গি পরিস্থিতি কেমন, কোথায় কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে— এ-সব নিয়ে তথ্য আদানপ্রদান করলে বিশেষজ্ঞেরা নিজেদের মতামত জানাতে পারেন। কিন্তু রাজ্য তা করছে না বলে জানান ওই বিশেষজ্ঞ।
এই প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘রাজ্য সরকার যে-তথ্য বিধানসভায় দিচ্ছে, তা দিল্লিতে পাঠাতে অসুবিধা কোথায়, আমরাও বুঝছি না। তথ্য পেলে টেকনিক্যাল সাপোর্ট, পরামর্শ দেওয়া যায়। কিন্তু তা করা যাচ্ছে না।’’
সব শুনে মুচকি হাসছেন স্বাস্থ্য ভবনের আধিকারিকেরা। প্রশ্ন হল, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy