সবে মিলি: পাভলভে চলছে কেক তৈরি। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
আভেন থেকে সদ্য উদয় হওয়া তপ্ত কেকের প্রথম দর্শনে চোখগুলি জ্বলে উঠেছিল বুধনি আর দুর্গার। ‘সুজিটা কী দা-রু-ণ হয়েছে গো!’
ওড়িশার প্রত্যন্ত গ্রাম কি দক্ষিণ ২৪ পরগনার অজ পাড়াগাঁয়ের দুই নারীর জীবনে এমন কমলালেবুর ঘ্রাণ সুরভিত কেকের অস্তিত্ব ত্রিসীমানায় ছিল না কখনও! তবু ভেবে-চিন্তে মিল খুঁজে জুতসই একটা নাম বার করেছেন। কেকের এই ‘সুজি’ উপাধিটা শুনে তখন চমৎকৃত শেফ সানশাইন ওরফে সঞ্চয়িতা আলম।
বড়দিনের প্রাক্কালে এমন কয়েকটি হাত ও মাথা একজোট হতেই তাজা কেকের সৌরভ বইছে পাভলভ মানসিক হাসপাতালে। হাসপাতালে রোগীদের পরিচর্যায় দীর্ঘদিনের শরিক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এগিয়ে এসেছে এই সেতু বাঁধার কাজে। সংস্থার অধিকর্তা রত্নাবলী রায় বলছিলেন, সঞ্চয়িতার দিক থেকেই প্রস্তাব আসে, হাসপাতালের মনোরোগীদের কাজে লাগে এমন কিছু করার জন্য। কেক তৈরির একটি আভেনও উপহার হিসেবে নিয়ে আসেন তিনি। আর তার পরেই ঘটছে কিছু ম্যাজিক। শেফ সানশাইন অকপট, ‘‘বেকিং ক্লাস আমি আকছার নিয়ে থাকি। কিন্তু তথাকথিত মনোরোগীদের মধ্যে এমন ঝকঝকে বুদ্ধিমতী ছাত্রীদের খুঁজে পাব, সত্যি ভাবিনি!’’ শেফের অভিজ্ঞতা, একেবারে নিরক্ষর কোনও কোনও শিক্ষার্থীও রেসিপিটা ঝটপট মুখস্থ করে ফেলেছেন। আবার কেউ কেউ আছেন, যথেষ্ট শিক্ষিত। রান্নায় কাদের আগ্রহ আছে যাচাই করেই, খানিক স্থিতিশীল রোগীদের মধ্যে থেকে বাছাই শুরু হয়েছিল শিক্ষার্থীদের। হাসপাতালের ক্যান্টিন ‘চা-ঘরে’ তাঁরা শেফের কাছে নাড়া বেঁধেছেন।
হাওড়ার মেয়ে, পদার্থবিদ্যার স্নাতক অঞ্জনা ঘোষ আত্মবিশ্বাসী, পরের বছরের বড়দিনের আগে হাসপাতাল থেকে ‘ছুটি’ পেয়ে দিদি-জামাইবাবুকে এমন কেক খাইয়ে তাক লাগিয়ে দেবেন। গত সেপ্টেম্বরে শেফের কর্মশালার পরে সপ্তাহে দিন তিনেক ধরে কাজ করে আপাতত দড়ো হয়ে উঠেছেন জনা ছয়েক রোগিণী। কেকের প্রাথমিক ব্যকরণ শেখার পরে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দাদা-দিদিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েই চলছে কেক-কুকি নিয়ে নিরীক্ষার কাজ। অরেঞ্জ পিল বা কমলালেবুর খোসা চিরে শুকোনোর কসরত কিংবা শুকনো ফল-বাদাম কি চকলেটযোগে রকমারি স্বাদের কেক তৈরিতেও চৌখস অনেকেই। পাভলভের সাইকায়াট্রি বিভাগের চিকিৎসক নীলাঞ্জন বসুর কথায়, ‘‘রোগীর অবস্থার একটু উন্নতি হলে নানা ধরনের কাজ শেখার মাধ্যমেও অকুপেশনাল থেরাপি কাজে আসে! সৃষ্টিশীল কাজে হাত লাগানোর আনন্দও রোগীদের বাড়তি প্রাপ্তি।’’
ইদানীং ব্যস্ত নাগরিক জীবনে বেকিং বা রকমারি রান্নার অভ্যেসকে অনেক নারী-পুরুষই মানসিক চাপ কাটানোর দাওয়াই হিসেবে দেখে থাকেন। চিকিৎসকদের মতে, মনোরোগীদের ক্ষেত্রে রান্না বা বেকিং এক ধরনের মগজের ব্যায়ামও বটে। উপকরণের খুঁটিনাটি মনে রাখা, মাপজোক ইত্যাদিতে মাথা খাটানো ছাড়া এ ভাবে রান্না মনঃসংযোগ বাড়াতে বা দলগত ভাবে কাজ করার জন্যও ভাল। তবে বুধনি-দুর্গা-অঞ্জনাদের বেকিং-প্রকল্পের শরিকেরা কেউই পেশাদারিত্বে আপস করছেন না। হিন্দুস্থান পার্কের একটি শাড়ি বিপণি-কাম-কাফে এবং ঢাকুরিয়া দক্ষিণাপনের একটি বুটিকে মিলবে পাভলভের আবাসিকদের তৈরি সুখাদ্য। চাহিদামাফিক কেক-কুকির বহর বাড়াতে একটি বড় আভেন তৈরির তোড়জোড় চলছে।
এই প্রকল্পের সাফল্যের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে হাসপাতালে পুরোদস্তুর বেকিং ইউনিট গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও দেখছেন অনেকেই। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে, দেশের শ্রম আইন অনুযায়ী এই কেক-কারিগরদের মজুরিও ধার্য হয়েছে ডিসেম্বরেই। পোস্তদানা খচিত সদ্যোজাত কেকের হয়ে পাকা সেলসম্যানের ভঙ্গিতে সওয়াল করছেন অঞ্জনা, মাখনের বদলে মার্জারিন, সাদা তেলের কেক খেলে বেশি মোটা হবেন না মোটেও! বেকিংয়ের ফাঁকে পুরনো জীবনে শোল-মাগুরের ঝোল বা পালক চিকেন রাঁধার সংসার-স্মৃতিও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে কোনও কোনও রোগিণীর চোখে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy