কিন্তু এ দিন ওই মিছিলের বিষয় বদলে করে দেওয়া হয় সাড়ে তিন বছর আগে দাড়িভিটের ছাত্র আন্দোলনে নিহত দুই ছাত্রের স্মরণ। বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চার সভাপতি চার্লস নন্দী আমতায় আনিসের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন বলেও বিজেপি জানিয়েছিল।
আনিস খানের অস্বাভাবিক মৃত্যুর প্রতিবাদে নাগরিক মিছিল চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে।
পথে নেমে ছাত্র-নেতা আনিস খানের মৃত্যুর প্রতিবাদ অব্যাহত। ভাষা দিবসে সোমবারও কলকাতার রাজপথে দফায় দফায় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হল আনিসের ‘হত্যাকাণ্ডের’ বিচার চেয়ে। পতাকা ছাড়া দেখা গেল নাগরিক মিছিল। আবার রাজনৈতিক ভাবেও ছাত্র সংগঠনের বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হল আন্দোলনকারীদের। হাওড়ায় আমতায় ঘটে যাওয়া আনিস-কাণ্ডে যে ভাবে সামাজিক প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে, তাতে দেড় দশক আগে পার্ক সার্কাসে রিজ়ওয়ানুর-কাণ্ডের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন অনেকে।
বস্তুত, বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা আনিসের মৃত্যু-পরবর্তী ঘটনার সঙ্গে রিজ়ওয়ানুর-কাণ্ডের তুলনা টানতে শুরু করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিনই আনিসের মৃত্যু-রহস্য তদন্তের জন্য সিট গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। রাজ্য সরকার ও পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, ‘‘নবান্নের এই সরকারের উপরে ভরসার কোনও কারণ নেই। রিজ়ওয়ানুর রহমানের দুঃখজনক আত্মহত্যার ঘটনার পরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে নিজে রিজ়ওয়ানের বাড়িতে গিয়েছিলেন। আর আমতায় নিহত আনিস খানের বাড়িতে গত কাল মধ্যরাতে কিছু টাকাপয়সা এবং চাকরির প্রলোভন নিয়ে গিয়েছিলেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর বাহকেরা! আবার এ দিন পুলিশ নিয়ে আনিসের বাড়িতে গিয়ে তাঁর বৃদ্ধ অসুস্থ পিতাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নবান্নে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।’’ সূর্যবাবুর অভিযোগ, আমতা হোক বা ডেউচা-পাঁচামি, সর্বত্রই শাসক পক্ষ ভয়-ভীতি বা প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিবাদ বন্ধ করার চেষ্টা করছে। সেই সঙ্গেই তাঁর হুঁশিয়ারি, ‘‘এ ভাবে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা সফল হবে না। সমাজের নানা অংশের মানুষ ইতিমধ্যেই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রতিবাদ করছেন। সবাইকে আরও বৃহত্তর আন্দোলনে শামিল করার চেষ্টা হবে।’’
বাম জমানায় রিজ়ওয়ানুর-কাণ্ডে প্রণয়-ঘটিত মামলায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল। বিচার চেয়ে পথে নেমেছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে রাজ্যের প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা, কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান বলেছেন, ‘‘রিজ়ওয়ানুরের জন্য এই মুখ্যমন্ত্রীই ইনসাফ চেয়েছিলেন। তখন দু’টো পরিবারের মধ্যে বিবাদে পুলিশের বিরুদ্ধে একটা পক্ষ নিয়ে সালিশি করার অভিযোগ ছিল। আনিসের ঘটনায় সরাসরি পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ। ঘটনার দু’দিন পরেও কেউ গ্রেফতার হয়ছে, অভিযুক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?’’
প্রতিবাদের মুখে শাসক দল অবশ্য দেখানোর চেষ্টা করছে, রাজ্য সরকার যথাযথ গুরুত্ব দিয়েই ঘটনার তদন্ত করছে। রাজ্যের মন্ত্রী পুলক রায় এ দিন আমতায় আনিসের এলাকায় গিয়ে বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী সাফ জানিয়েছেন, এই ঘটনার নিরপেক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে। রাজ্য সরকার নিহত যুবকের পরিবারের পাশে আছে।’’ আনিস তাঁদেরই লোক ছিলেন বলে দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রীও। যদিও বিরোধী সিপিএম ও কংগ্রেস নেতারা কটাক্ষ করেছেন, মৃত্যুর পরে অনেককেই এ ভাবে ‘নিজের লোক’ বলে দাবি করে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী!
এরই পাশাপাশি পুলিশ সূত্রে একটি ফোনালাপের অডিয়ো-ক্লিপ (যার সত্যাসত্য আনন্দবাজার যাচাই করেনি) প্রকাশ্যে এসেছে, যেখানে আনিসের এক আত্মীয়া বলছেন তাঁরা ওই ছাত্র-নেতার মোবাইল ফোন পুলিশকে দেননি। নিজেদের কাছেই রেখেছেন। শাসক শিবিরের তরফে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, নিরপেক্ষ তদন্ত চাইলে মৃত ছাত্রের মোবাইল পুলিশকে দিতে আপত্তি কেন থাকবে?
আনিসের মৃত্যুর বিচার চেয়ে এ দিন নানা প্রান্তেই চলেছে প্রতিবাদ। ভাষা দিবস মিছিলুখতেই এ দিন হয়েছে আনিসকে মনে রেখেই। ধর্মতলা থেকে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ হয়ে মহাজাতি সদন পর্যন্ত বিচারের দাবিতে ওই মিছিলে দেখা গিয়েছে বহু বাম নেতা, যুব ও ছাত্র সংগঠনের নানা মুখকেই। আনিস তাদের সংগঠনের প্রাক্তন সদস্য ছিলেন বলে দাবি করে তাঁর মৃত্যুর সিবিআই তদন্ত চেয়ে এ দিন বিধান ভবন থেকে মিছিলের ডাক দিয়েছিল ছাত্র পরিষদ। কিন্তু মিছিল মৌলালির দিকে এগোতে শুরু করলে রামলীলা ময়দানের কাছেই পুলিশের সঙ্গে কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠনের ধস্তাধস্তি বাধে। আহত হন ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি সৌরভ প্রসাদ, সাধারণ সম্পাদক মোশারফ দর্জি-সহ বেশ কয়েক জন। তার মধ্যেই রামলীলা ময়দানের সামনে ঘণ্টাখানেক অবস্থানে বসে পড়েন সৌরভেরা। আনিস-কাণ্ড ও প্রতিবাদ থামাতে পুলিশের ভূমিকার তীব্র নিন্দা করে পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন তাঁরা।
গোটা রাজ্যের পাশাপাশি কলকাতায় প্রেসিডেন্সি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এ দিন পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায় ছাত্র সংগঠন ডিএসও। আনিসের মৃত্যুর ঘটনায় প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ দিন বিক্ষোভ দেখায় এসএফআইয়ের ইউনিট। কিছু ক্ষণের জন্য কলেজ স্ট্রিট অবরোধও করে তারা। আনিসের মৃত্যুর যথাযথ তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। এসএফআই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয আঞ্চলিক কমিটির পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ, মঙ্গলবার ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে।
তবে এরই মধ্যে আনিস-কাণ্ডে আন্দোলন কর্মসূচি নিয়েও তা থেকে সরে এসেছে বিজেপি। দলের উত্তর কলকাতা জেলা সভাপতি কল্যাণ চৌবে রবিবার জানিয়েছিলেন, আনিসের নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে এ দিন সন্ধ্যায় শোভাবাজার মোড় থেকে মোমবাতি মিছিল করা হবে। কিন্তু এ দিন ওই মিছিলের বিষয় বদলে করে দেওয়া হয় সাড়ে তিন বছর আগে দাড়িভিটের ছাত্র আন্দোলনে নিহত দুই ছাত্রের স্মরণ। বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চার সভাপতি চার্লস নন্দী আমতায় আনিসের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন বলেও বিজেপি জানিয়েছিল। পরে সেই কর্মসূচিও বাতিল করা হয়। বিজেপি সূত্রের খবর, আনিসের ঘটনার সঙ্গে সচেতন ভাবেই দূরত্ব রাখতে চাইছেন দলীয় নেতৃত্ব। রাজ্য বিজেপির নেতা সায়ন্তন বসু বলেন, ‘‘আনিস খানের সামাজিক মাধ্যমের নানা পোস্ট দেখে মনে হচ্ছে, ভারতবিরোধী শক্তির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। যদিও গোটা বিষয়টাই তদন্ত সাপেক্ষ।’’ এই অনুমান থেকেই কি বিজেপি এ দিনের আনিস-কেন্দ্রিক কর্মসূচিগুলি বাতিল করেছে? এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, ওই কর্মসূচিগুলির বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই। তবে কল্যাণের দাবি, ‘‘দাড়িভিটে ভাষার জন্য আন্দোলন করতে গিয়েই দুই ছাত্র শহিদ হয়েছিলেন। তাই এ দিনের মিছিলে তাঁদের স্মরণ করা হয়েছে। তবে আনিসের হত্যার প্রতিবাদও তার সঙ্গে ছিল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy