প্রতীকী ছবি।
শুধু টাকার পাহাড় নয়, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে শিক্ষা দফতরের বিভিন্ন নথি, দফতরের ছাপ মারা খাম পাওয়া গিয়েছে বলেও ইডি দাবি করেছে। এর আগেও আদালতের পর্যবেক্ষণ এবং সিবিআই তদন্ত থেকে ইঙ্গিত, শিক্ষায় দুর্নীতির ডালপালা নীচু তলা থেকে উপরতলার একাংশে ছড়িয়েছে। দিনের পর দিন ধর্মতলায় ধর্না দেওয়া বা আদালতে যাওয়া চাকরিপ্রার্থীদেরও দাবি, তাঁদের অভিজ্ঞতা বলছে, জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে টাকা পৌঁছেছে ‘উপরতলায়’।
চাকরিপ্রার্থীরা জানিয়েছেন, সাধারণত এলাকার দালালদের নিশানায় ছিলেন প্রাথমিকের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বা বিএড প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা। স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার জন্য আবেদনের পরই তাঁদের টাকার বিনিময়ে চাকরির টোপ দেওয়া হয়। তার মধ্যে সাদা খাতা জমা দিতে বলা থেকে শুরু করে, প্রতিটি স্তরে উত্তীর্ণ করার আশ্বাস ছিল। তাঁরা রাজি হলে তখন টাকা নিয়ে দর কষাকষি। ‘২০১৪ প্রাইমারি টেট পাশ, ট্রেন্ড নট ইনক্লুডেড ক্যান্ডিডেট একতা মঞ্চ’-এর সম্পাদক অচিন্ত্য সামন্তের কথায়, ‘‘শুধু টাকার বিনিময়ে র্যাঙ্কিংয়ের হেরফের করে বা সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরিই নয়, আরও নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এই নিয়ে মামলাও করব।” কী সেই অভিযোগ? তাঁর কথায়, “২০১৪ সালের নোটিফিকেশন অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরির আবেদন করার সর্বনিম্ন বয়সসীমা ছিল ১৮ বছর। কিন্তু আবেদনের সময় বয়স ১৮ হয়নি, এমন প্রার্থীকেও আমরা জানি। সেই প্রার্থী এখন প্রাথমিক স্কুলে চাকরি করছেন। কোন যাদুবলে চাকরি করছেন, তা আর এখন বুঝতে অসুবিধা হয় না। প্রাথমিকে চাকরির ক্ষেত্রে ‘রেট’ ১০ লক্ষের আশপাশে থাকলেও বয়স ভাঁড়ানোর ক্ষেত্রে তা অনেক বেড়ে যায়। গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি, উচ্চ প্রাথমিক, নবম থেকে দ্বাদশ সব ক্ষেত্রেই বিশেষ ‘রেট’ রয়েছে।’’
চাকরিপ্রার্থীদের দাবি, তাঁরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন, দালালরা চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকার খাম এবং যোগ্যতার নথি পৌঁছে দিত এলাকার ‘প্রভাবশালী নেতার’ কাছে। তারপর টাকা যেত জেলার কোনও ‘প্রভাবশালীর’ কাছে, তার পর তা পৌঁছত রাজ্য স্তরে। সেখান থেকে টাকা শিক্ষা দফতরের আধিকারিকদের কাছে পৌঁছত কি না, সেই নিয়ে তদন্ত করছে সিবিআই। শিক্ষা সচিব মনীশ জৈনকে ইতিমধ্যেই নিজাম প্যালেসে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
বিভিন্ন এলাকায় যে দালালরা টাকার বিনিময়ে চাকরির টোপ দিত, তারা বেশির ভাগ এলাকার রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ঘনিষ্ঠ বলেই চাকরিপ্রার্থীদের দাবি। পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা থেকে পাওয়া অডিয়ো টেপে শোনা গিয়েছিল, এক দালাল নিজেকে এলাকার এক নেতার ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করছে এবং এক মহিলা প্রার্থীকে চাকরির টোপ দিয়ে বলছে, ১৮ লক্ষ টাকা থেকে সে নেবে ১ লক্ষ, বাকি টাকা ‘দফতরকে দিতে হবে’। এই অডিয়ো টেপ হাইকোর্টেই শুনিয়েছিলেন এক আইনজীবী।
কোচবিহার, আলিপুরদুয়ারের উদাহরণ নেওয়া যাক। সেখানে চাকরিপ্রার্থীদের থেকে কমপক্ষে চার হাত বদলে টাকা পৌঁছয় জেলার মাথাদের কাছে। সেখান থেকে কলকাতায়। পাশের জেলা দক্ষিণ দিনাজপুরে আবার শিক্ষকরাই চক্রে জড়িয়ে বলে অভিযোগ। জলপাইগুড়িতেও একাধিক শিক্ষক নেতা এবং তাঁদের আত্মীয়দের বিরুদ্ধে টাকা তোলার অভিযোগ রয়েছে। কখনও কখনও শিক্ষক নেতা সরাসরি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর এক ঘনিষ্ঠকে টাকা দিয়ে এসেছেন বলেও দাবি। শিলিগুড়িতে সন্দেহের তালিকায় এক তৃণমূল নেতা। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী উত্তরবঙ্গে গেলে তিনিই দেখভাল করতেন। সন্দেহ, ওই নেতার মাধ্যমেও হত লেনদেন।
স্কুলে চাকরির জন্য রাজনৈতিক নেতাদের টাকা দেওয়া দস্তুর হয়ে গিয়েছিল জেলায় জেলায়। বীরভূমের তারাপীঠ থানার বুধিগ্রাম পঞ্চায়েতের লাহা গ্রামের গোলকবিহারী দাস ২০১৪ সালে ছেলের প্রাথমিকে চাকরির জন্য পঞ্চায়েত প্রধানকে ৪ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। চাকরি হয়নি, টাকাও পাননি। সম্প্রতি রামপুরহাটের মহকুমাশাসকের দ্বারস্থ হয়েছেন ক্যানসার আক্রান্ত গোলক। টাকা দিয়েও চাকরি না হওয়ায় সম্প্রতি প্রকাশ্যে ইলামবাজারের এক তৃণমূল নেতার পায়ে ধরতে দেখা গিয়েছিল এক চাকরিপ্রার্থীকে। বোলপুরের এক নেতা আবার জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ পেয়ে খয়রাশোলে দলেরই এক প্রয়াত নেতার স্ত্রীর থেকে তাঁর আত্মীয়ের চাকরি করে দেওয়ার নামে ৯ লক্ষ টাকা নেন বলে অভিযোগ। টাকা ফেরত না পেয়ে প্রকাশ্যেই ওই নেতাকে অপমান করেন মহিলা। শেষে দলের হস্তক্ষেপে টাকা ফেরাতে বাধ্য হন নেতা।
(সহ প্রতিবেদন: দয়াল সেনগুপ্ত, অনির্বাণ রায়, নমিতেশ ঘোষ, পার্থ চক্রবর্তী, শান্তশ্রী মজুমদার)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy