একটা-দু’টো নয়। পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের ধরতে এ বছর ঝাড়খণ্ড পুলিশ ও সিআরপি-কে সঙ্গে নিয়ে সাত-সাতটা পুলিশি অভিযান হলেও নিট ফল এখনও শূন্য! রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (আইবি)-র রিপোর্টেই এ কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দাদের এই পর্যবেক্ষণ সম্প্রতি দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ডাকা মাওবাদী কার্যকলাপের বিষয়ে পর্যালোচনা গোষ্ঠীর (রিভিউ গ্রুপ) বৈঠকেও জানানো হয়েছে।
জুনের ওই বৈঠকে তুলে ধরা হয়েছে সাতটি অভিযানের বিস্তারিত তথ্য। দুর্গম জঙ্গল এলাকায় বাহিনী যে হেঁটেই অভিযান চালিয়েছিল— তার উল্লেখ রয়েছে রিপোর্টে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে টানা ৭২ ঘণ্টা তল্লাশি চালানো হয়েছে।
কিন্তু কোনও মাওবাদীকে ধরা তো দূরের কথা, অভিযানে অস্ত্র, এমনকী চকোলেট বোমাও উদ্ধার করা যায়নি! রাজ্য পুলিশের স্বীকারোক্তি: পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলের মাওবাদী প্রভাবিত এলাকায় পুলিশ-সিআরপি যৌথ ভাবে এরিয়া ডমিনেশন, নাকা, অ্যামবুশ, এলআরপি নিয়মিত চালালেও জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত তেমন সাফল্য মেলেনি।
শুধু এই বছরই নয়, ২০১২-র অগস্টে রঞ্জন মুন্ডা গ্রেফতার হওয়ার পর জঙ্গলমহলের আর কোনও গুরুত্বপূর্ণ মাওবাদী নেতা কেন ধরা পড়ল না, তার জবাবে রাজ্য পুলিশের কর্তাদের অনেকেরই বাঁধাধরা উত্তর— ‘‘ওরা পশ্চিমবঙ্গে বড় একটা ঢুকছে না। ঝাড়খণ্ডের সীমানা ঘেঁষা কিছু পাহাড়-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’’
এবং ওই সাতটি অভিযান হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডের সীমানা বরাবরই। পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি ও জামবনি, পুরুলিয়ার বান্দোয়ান থানা এলাকা এবং ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংহভূম জেলার চাকুলিয়া, গালুডি ও ঘাটশিলা থানার কিছু পাহাড় ও জঙ্গলে এবং প্রত্যন্ত গ্রামে ওই যৌথ অভিযানে কোথাও রাজ্য পুলিশের প্রশিক্ষিত বাহিনী সিআইএফ, কোথাও সিআরপি-র ১৪৮, ১৯৩ বা ১৬৫ নম্বর ব্যাটেলিয়ন সামিল হয়েছে। কিন্তু তাদের ফিরতে হয়েছে খালি হাতে।
অথচ গোয়েন্দা-রিপোর্টেই দাবি, বেলপাহাড়ি ও চাকুলিয়া এলাকায় মদনের স্কোয়াড এবং শ্যামল ও রেখার স্কোয়াড, বান্দোয়ান ও পটমদা এলাকায় শচীনের স্কোয়াড আর জামবনি ও ঘাটশিলার সীমানা বরাবর জয়ন্তর স্কোয়াডের গতিবিধি রয়েছে।
তা হলে মাওবাদীরা ধরা পড়ছে না কেন?
এক সিআইএফ কর্তার বক্তব্য, প্রাক্তন মাওবাদী, মাও-সমর্থকদের অনেকেই ভয়ে-ভক্তিতে বা আর্থিক কারণে শাসক দলের অনুগত হয়েছে। ‘‘এদের একাংশ মন থেকে তৃণমূলে যায়নি, সময় ও সুযোগের অপেক্ষা করছে। মাওবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগও রাখছে। শুধু পাহাড়ে-জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে সাফল্য পাওয়া কঠিন,’’— বলেন ওই অফিসার। তাঁর মতে, কিছু পঞ্চায়েতে দুর্নীতি, ঠিকাদারি স্বজনপোষণ ও শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফলে মাওবাদীদের লিঙ্কম্যানরা উৎসাহ পাচ্ছে ও সাহস বেড়েছে মাওবাদীদের।
সম্প্রতি রাজ্য পুলিশ খবর পায়, ছত্তীসগঢ় ও ঝাড়খণ্ডে পুলিশের গুলিতে জখম কিছু মাওবাদী পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে চিকিৎসার জন্য আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু সেই আশ্রয়দাতাদের চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। ঘাটশিলায় পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত এক বাঙালির কথায়, ‘‘মাওবাদী নেতা রঞ্জিত পাল পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কাছে ওয়ান্টেড। কিন্তু ঘাটশিলার বহু মানুষের কাছে ওর ভাবমূর্তি এক জন রবিনহুডের। এখানে ওর নাম রাহুল। ওকে ধরা মুশকিল।’’ রঞ্জিতের বাড়ি বাঁকুড়ার বারিকুলে। এক গোয়েন্দা-অফিসারের দাবি, ‘‘রঞ্জিতের সঙ্গে ওর গ্রামের কয়েক জনের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। তবু তাঁরা কিছুতেই আমাদের কাছে মুখ খোলেন না।’’
উল্টে, ছত্রধর মাহাতোর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তির বিরুদ্ধে মাওবাদীরা বনধের ডাক দিয়েছে বলে চাউর হতে না হতেই উৎসাহিত হয়েছেন বিনপুরের একদল যুবক। যাঁরা মাওবাদীদের তৈরি পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটির কর্তা ছিলেন। এখন ঠিকাদারির কাজ করেন ও শাসক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেন। তাঁদের কথায়, ‘‘আমরা তো ব্যবসা করে খাচ্ছি। যারা দুর্নীতি করছে, তারা এ বার বুঝবে!’’
আবার লালগড়ের এক যুবককে মাওবাদীরা তিনটি আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে দিয়েছিল। সম্প্রতি তিনি জানতে পারেন, ওই তিনটি বন্দুক থানায় জমা দিলে কিছু টাকা মিলবে। কিন্তু জনসাধারণের কমিটির এক প্রাক্তন নেতা তাঁকে বলেন, ‘‘পুরনো দিন ফিরে আসতে চলেছে। এগুলো কাজে লাগবে। পুলিশকে দিয়ে কী লাভ!’’ অথচ কমিটির ওই প্রাক্তন নেতা শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত, এলাকায় মাঝেমধ্যে দেখা গেলেও পুলিশের খাতায় তিনি ‘ফেরার’।
আইবি-র এক কর্তা বলেন, ‘‘এ রকম বহু লোক শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলে ভেক ধরে রয়েছে।’’ ওই গোয়েন্দা-কর্তার মতে, ‘‘খুনজখম নতুন করে শুরু হলে মানুষ আবার আতঙ্কে ভুগবে, জনমত ফের বিরুদ্ধে যাবে। মূলত সেই জন্যই কিছুটা দ্বিধায় আছে মাওবাদীরা।’’
বন্দির ইচ্ছে
নন্দীগ্রাম জমি আন্দোলনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ধৃত মাওবাদী নেতা শচীন ঘোষাল তাঁর মৃত্যুর পরে দেহ দানের ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। আলিপুর জেলা আদালতের সরকারি আইনজীবী প্রশান্ত মজুমদার শনিবার জানান, তাঁর ওই ইচ্ছেকে সাধুবাদ জানিয়েছে আদালত। শচীনবাবু এখন প্রেসিডেন্সি জেলে বিচারাধীন বন্দি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy