রামপুরহাটে আক্রান্ত পুলিশ অরুণ মুখোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার। ছবি: উদিত সিংহ।
পুলিশের ‘কঠিন সময়’ আর কাটছে না।
কখনও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের হাতে, কখনও বা রাজনীতির লড়াইয়ের মাঝে পড়ে ক্রমাগত আক্রান্ত হয়ে চলেছেন পুলিশকর্মীরা।
বুধবার গভীর রাতে বীরভূমের রামপুরহাটের হাটতলায় টহলদারি দুই পুলিশ কর্মীকে শুধু মারধরই নয়, তাঁদের কাছ থেকে বন্দুক ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করা হয় বলে অভিযোগ। আহত এক পুলিশ কর্মীকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। এ বার অবশ্য, পুলিশ-পেটানোর অভিযোগের আঙুল এক দল মদ্যপ যুবকের দিকে।
ওই ঘটনায় ‘সন্দেহজনক’ হিসেবে চিহ্নিত করে বাবু শেখ নামে এক ভ্যানচালককে গ্রেফতার করা হলেও হাটতলার ঘটনায় সরাসরি সে জড়িত কিনা তা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেই সন্দেহ রয়েছে। বৃহস্পতিবার ধৃত ওই যুবককে রামপুরহাট আদালতে তোলা হলে বিচারক তাকে চার দিনের পুলিশ হেফাজতে পাঠিয়েছেন।
গত ৩ সেপ্টেম্বর, মদ্যপ অবস্থায় সদলবলে বোলপুর থানায় ঢুকে কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারকে মারধর করার অভিযোগ উঠেছিল বীরভূমের যুব তৃণমূল সভাপতি সুদীপ্ত ঘোষের বিরুদ্ধে। ঘটনার পর বীরভূম জেলা পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া আক্ষেপ ছিল, “পুলিশ বড় কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।” পরে, তাঁর মন্তব্যের ‘ভুল’ ব্যাখ্যা হয়েছে বলে দাবি করলেও সেই ‘কঠিন’ সময় থেকে পুলিশ যে বেরোতে পারেনি হাটতলার ঘটনা তারই প্রমাণ। থানায় তাণ্ডবের পরে শাসক দল সুদীপ্তকে বহিষ্কার করার কথা বললেও তাঁকে গ্রেফতার করার ‘সাহস’ দেখাতে পারেনি বীরভূম জেলা পুলিশ।
বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কটাক্ষ, “কঠিন সময় থেকে বেরনোর সাহস পুলিশ দেখাবেই বা কী করে?” তাঁর দাবি, তৃণমূলের ‘বহিষ্কার’ নিছকই লোক দেখানো। রাহুল বলেন, “সে জন্যই, সুদীপ্ত থেকে আরাবুল, বহিষ্কারের পরেও পুলিশ তাঁদের টিকি ছোঁয়ার সাহস দেখায় না।”
ঘটনা হল, ‘পরিবর্তনের’ পরে রাজ্যে পুলিশের উপরে আক্রমণের বিরাম নেই। শুধু বীরভূমেই পুলিশ-প্রহারের অন্তত চারটি বড় ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগের আঙুল, কখনও শাসক দলের আশ্রিত গুন্ডা, কখনও বা সরাসরি রাজনৈতিক দলের নেতাদের দিকে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল মঞ্চ থেকে পুলিশকে বোমা মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পাড়ুইয়ের বাঁধ নবগ্রামে তার জেরেই খুন হন সাগর ঘোষ। গত ৩ জুন, বীরভূমের আউলিয়া গ্রামে তৃণমূল-সিপিএম সংঘর্ষ রুখতে গিয়ে বোমার ঘায়ে গুরতর জখম হন দুবরাজপুর থানার এসআই অমিত চক্রবর্তী। পরে তাঁর মৃত্যু হয়। ওই পুলিশকর্মী খুনের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ তৃণমূলের শেখ আলিম এখনও ধরা পড়েনি। ১৯ জুলাই এক ব্লক তৃণমূলে নেতা খয়রাশোলের লোকপুর ফাঁড়িতে দলের কর্মীদের নিয়ে হামলা চালায়। বেশ কিছু দিন পলাতক থাকার পরে অভিযুক্তদের একাংশ আদালতে আগাম জামিন নিয়েছেন। ২৪ অক্টোবর চৌমণ্ডলপুরে মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন পাড়ুই থানার ওসি প্রসেনজিৎ দত্ত। উদাহরণ অন্য জেলাতেও কম নেই।
গত বছর ১২ জানুয়ারি কলকাতায় গার্ডেনরিচ এলাকায় হরিমোহন ঘোষ কলেজে ছাত্র নির্বাচনে মনোনয়নপত্র তোলাকে ঘিরে হাঙ্গামায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান কলকাতা পুলিশের এসআই তাপস চৌধুরী। ওই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ছিলেন শাসক দলের নেতা মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্না। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙর থানায় অনুগামীকে ছাড়াতে গিয়ে থানার গেট ঝাঁকিয়ে হুমকি দিয়ে আসেন তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলাম। ২৭ অক্টোবর বাঁকুড়ার ডিএসপি বাপ্পাদিত্য েঘাষকেও মারধর করে হয় বলে অভিযোগ। বুধবার রিষড়ার হেস্টিংস জুটমিলে শ্রমিক অসন্তোষ সামাল দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয় পুলিশ। আহত হন তিন পুলিশ কর্মী। ক্রমান্বয়ে পুলিশ-প্রহারের তালিকায় শেষ সংযোজন, বুধবার রামপুরহাটের হাটতলার ঘটনাটি।
ওই দিন রাতে, হাটতলা এলাকায় এক এনভিএফ কর্মীকে নিয়ে টহল দিচ্ছিলেন কনস্টেবল অরুণ মুখোপাধ্যায়। হঠাৎই বাজারের গলি থেকে মোটরবাইক চালিয়ে বেরোয় তিন যুবক। আক্রান্ত’ এনভিএফ কর্মী ৫৯ বছরের জগন্নাথ সরকার বলেন, “ওরা যাওয়ার সময় আমাদের গালিগালাজ করে। অরুণবাবু এগিয়ে গিয়ে এক জনকে ধরে ফেলতেই ওরা আমাকে লোহার রড দিয়ে মারে। পরে অরুণবাবুকে ঘুষি মেরে তাঁর কাছে থাকা রাইফেল ছিনিয়ে নেওয়ারও চেষ্টা করে।” তবে, অরুণবাবুর কথায়, “ওরা গালি দিতেই আমি তাদের ধরে ফেলি। শুরু হয় ধস্তাধস্তি। তখনই আমার চোখে-মুখে আঘাত লাগে।”
যা শুনে ধূপগুড়ি মিলপাড়া ময়দানে জনসভায় রাহুল সিংহের কটাক্ষ, “শাসক দলের নেতারাই এখন পুলিশ-শাসন করছেন, পুলিশকে বোমা মারতে বলেছেন। দলের নেতাদের দেখেই দুষ্কৃতীরা সাহস পাচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy