সিউড়ি জেলাশাসকের দফতরের সামনে বিজেপি সমর্থকদের আইন অমান্য। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।
জেল হাজতের মেয়াদ কাটিয়ে প্রত্যেকেই জামিন পেয়ে গিয়েছেন। এ বার সেই জামিনের বিরোধিতা করে জেলা জজের এজলাসে আবেদন করল বীরভূম পুলিশ।
পাড়ুইয়ের চৌমণ্ডলপুর গ্রামে পুলিশের উপরে হামলার অভিযোগে ধৃত বিজেপি কর্মীদের ক্ষেত্রে পুলিশের এই ‘সক্রিয়তা’ নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বিজেপি-র অভিযোগ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই পুলিশের ওই আবেদন। শাসক দলের ধৃত কর্মী-সমর্থকদের ক্ষেত্রে পুলিশের এই তৎপরতা কেন দেখায় না, তা নিয়েও বিজেপি প্রশ্ন তুলেছে।
এই বিতর্কের মধ্যেই এ দিন বীরভূম পুলিশের অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে তুলেছে পাড়ুইয়েরই দুবশঙ্কা গ্রাম। চৌমণ্ডলপুরের মতো সেখানেও তল্লাশির নামে পুলিশের বিরুদ্ধে তাণ্ডব চালানোর অভিযোগ উঠেছে। বিজেপি-র অভিযোগ, গ্রামের তিন জনকে শুধু ধরে নিয়ে যাওয়াই নয়, বাড়িতে ঢুকে মারধর করা, ভাঙচুর চালানোর পাশাপাশি মাঠ পাহারার জন্য অস্থায়ী চালাঘরে আগুনও লাগিয়েছে পুলিশ। এ দিনই আবার জেলাশাসকের দফতরে বিজেপি যে আইন-অমান্য কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল, তা সামলাতেও দিনভর নাকানিচোবানি খেতে হয়েছে জেলা পুলিশকে। যেখানে দলের জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলের নেতৃত্বে প্রথমে প্রবল ধস্তাধস্তি, পরে ব্যারিকেড ভেঙে জেলাশাসকের দফতরে ঢুকে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করেন কয়েকশো বিজেপি কর্মী-সমর্থক। বিজেপি নেতৃত্বের হুঁশিয়ারি, সাত দিনের মধ্যে পুলিশি ‘তাণ্ডব’ বন্ধ না হলে এবং নিরপেক্ষাতা বজায় না থাকলে জেলা স্তব্ধ করে দেওয়া হবে।
গত ২৪ অক্টোবর বোমা উদ্ধারে গিয়ে চৌমণ্ডলপুরে আক্রান্ত হন পাড়ুই থানার ওসি প্রসেনজিৎ দত্ত। স্থানীয় বিজেপি নেতা শেখ সদাই-সহ ৪৩ জন বিজেপি কর্মী-সমর্থকের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পুলিশ মামলা রুজু করে। কয়েক দফায় গ্রামে হানা দিয়ে ১৯ জনকে গ্রেফতারও করে। বর্তমানে তাঁরা সকলেই জামিনে মুক্ত। প্রথম দফায় যে সাত জনকে বীরভূমের মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) জামিন দিয়েছিলেন, তাঁদের জামিনপ্রাপ্তির বিরোধিতা করে এ দিন সরকারি আইনজীবী রণজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় জেলা জজ গৌতম সান্যালের এজলাসে আবেদন করেন।
কেন এই আবেদন?
রণজিৎবাবুর বক্তব্য, “পুলিশ সুপারের নির্দেশে ওই আবেদন জানিয়েছি। এমনিতেই পাড়ুই এখন অশান্ত। পুলিশ সাধ্যমতো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। এমন সময় যারা পুলিশকে বোমা মারার মতো ঘটনায় অভিযুক্ত, তাদের এত সহজে জামিনে মুক্তি দেওয়া হলে এলাকা ফের অশান্ত হতে পারে।” বুধবার একই ভাবে সিউড়িতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্মীকে হেনস্থায় অভিযুক্ত এক যুবকের জামিন পাওয়ার বিরোধিতা করে জেলা জজের কাছে আবেদন করেছিল পুলিশ।
সাত দলীয় কর্মীর জামিনের বিরোধিতার পিছনে ‘রাজনৈতিক চক্রান্ত’-এর ছায়াই দেখছে বিজেপি। দুধকুমারের অভিযোগ, “সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে প্রথমে পুলিশি হেফাজত, তার পরে এত দিন জেল হাজত খেটে আমাদের কর্মীরা ছাড়া পেয়েছেন। এ বার তার বিরোধিতা করে বীরভূমের পুলিশ প্রমাণ করে দিল তারা কতটা নিরপেক্ষ! আসলে পুলিশের এই অতি-সক্রিয়তা শাসক দলের নির্দেশেই।” তাঁর দাবি, অভিযুক্তেরা শাসক দলের আশ্রয়ে থাকলে পুলিশের এই তৎপরতা দেখা যেত না। জামিনে মুক্ত ওই সাত দলীয় কর্মীকে এ ব্যাপারে আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য তাঁরা চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন বলেও দুধকুমার জানিয়েছেন। এর আগে পাড়ুইয়েরই ইমাদপুর গ্রামে বিজেপি-তৃণমূল সংঘর্ষে ধৃতদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার ব্যাপারে পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ উঠেছিল। একই ঘটনায় বিজেপি কর্মীদের ক্ষেত্রে খুনের চেষ্টার ধারা দিলেও তৃণমূল কর্মীদের ক্ষেত্রে তুলনায় ‘লঘু’ ধারায় মামলা রুজু করেছিল পুলিশ।
ঘটনা হল, বীরভূমে এর আগে পুলিশ আক্রান্তের ঘটনায় বারবার নাম জড়িয়েছে তৃণমূলের। খয়রাশোলের লোকপুর ফাঁড়ি থেকে বোলপুর থানা অধিকাংশ ঘটনায় অভিযুক্ত শাসক দলের নেতা-কর্মীরাই। বোলপুর থানায় ঢুকে পুলিশকর্মী পেটানোয় যুব তৃণমূলের তৎকালীন জেলা সভাপতি সুদীপ্ত ঘোষের বিরুদ্ধে পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই মামলা রুজু করেছিল। ওই ঘটনায় পুলিশের খাতায় ‘পলাতক’ সুদীপ্তর দু’বার আগাম জামিনের আবেদন আদালতে খারিজ হয়েছে। কিন্তু ওই ঘটনায় সিউড়ি এবং বোলপুর আদালতে পুলিশের হয়ে সওয়াল করতে উঠে সরকারি আইনজীবী রণজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ই সুদীপ্তর জামিনের বিরোধিতা করেননি। উল্টে, বিচারকের কাছে অভিযুক্তেরই জামিনের পক্ষে সওয়াল করেছেন! এমনকী, লোকপুর ফাঁড়িতে হামলার ঘটনায় মাসখানেক আগে সিউড়ি আদালতেই কয়েক জন তৃণমূল নেতা-কর্মী আগাম জামিন পেয়েছেন। সে বারও রণজিৎবাবুকে জামিনের বিরোধিতা করতে দেখা যায়নি।
বীরভূমের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া অবশ্য ধৃত বিজেপি কর্মীদের জামিনের বিরোধিতার ক্ষেত্রে কোনও রাজনীতি দেখতে পাচ্ছেন না। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “সকলেরই আইনের অধিকার রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের মনে হয়েছে, তাই উচ্চ আদালতে আবেদন করেছি।” ঘটনাচক্রে, এ দিনই মাখড়া-কাণ্ডে পুলিশের স্বতঃপ্রণোদিত মামলায় জেল হাজতে থাকা ছয় তৃণমূল কর্মী এবং এক বিজেপি কর্মী জামিন পেয়েছেন। যাঁদের বিরুদ্ধে খুনের মতো গুরুতর অভিযোগ, একই যুক্তিতে তাঁরা ফিরলেও তো এলাকা অশান্ত হতে পারে! শাসক দলের ওই লোক জনের বিরুদ্ধেও কী পুলিশ একই পদক্ষেপ করবে? উত্তর মেলেনি এসপি-র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy