ট্রেনের মধ্যে সুধীর ঘোষ। সোয়েটারে লেখা ফোন নম্বর। —নিজস্ব চিত্র
হাতে একগোছা টাটকা খবরের কাগজ। পরনে নেভি ব্লু রঙের ফুল প্যান্ট। লাল-কালো-সাদার চেক কাটা ফুলহাতা শার্ট। তার উপরে গাঢ় আকাশি রঙের হাফ সোয়েটার আর মাথায় নস্যি রঙের হনুমান টুপি। মোজাহীন পায়ে স্যান্ডেল।
পাশে বসে থাকা ট্রেনযাত্রীদের সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। তাঁদের কথা শুনে হাসছেন। আলোচনায় কখনও চলে আসছেন মোদী-মমতা, কখনও বা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল। মাঝে মধ্যে তিনি আলোচনা ঘুরিয়ে দিচ্ছেন— ট্রেনটা বেশ জোরে চলছে, ঠান্ডাটা কমেই গেল... ইত্যাদি।
কিন্তু, বারে বারেই সহযাত্রীদের চোখ চলে যাচ্ছে আকাশি সোয়েটারের উপর এমব্রয়ডারি করে লেখা একটি মোবাইল নম্বরে। বুকের উপর কেন এ ভাবে মোবাইল নম্বর লেখা? অনেক সংস্থার ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাদের কর্মীদের পোশাকে কোম্পানির নাম বা লোগো বসানো থাকে। কিন্তু মোবাইল বা ফোন নম্বর... নাহ্, তেমনটা দেখা যায় না। কাজেই, কৌতূহল বাড়ে। বুকের কাছে কেন লেখা মোবাইল নম্বর? সে ‘রহস্য’ উদ্ঘাটন হতেই জানা যায়, আশ্চর্য এক ‘নেশা’র কথা।
সৌজন্যের গণ্ডি এবং আলোচনা পেরিয়ে ভদ্রলোককে আর ট্রেনের ভিতরে জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি, কেন তিনি বুকে মোবাইল নম্বর সাঁটিয়ে ঘুরছেন? কিন্তু ট্রেন থেকে নেমে সেই নম্বরে ডায়াল করতেই হল। রাত তত ক্ষণে সাড়ে ১২টা পেরিয়েছে। দু’এক বার রিং হতেই মোবাইলের উল্টো দিকের পুরুষ কণ্ঠ কোনও ‘হেলো’ ছাড়াই এক রাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘‘কোথায় দেখলেন?’’ হতভম্ভ ভাব কাটিয়ে জানানো গেল, ‘‘গোবরডাঙা।’’ ‘‘আপনি নেমে গিয়েছেন?’’ ‘‘হ্যাঁ’’। এ বার উৎকণ্ঠা বদলে গেল ক্ষোভে, ভেসে এল, ‘‘একটু আগে ফোন করতে পারলেন না! ছেলেটাকে তা হলে আর এই ঠান্ডায় বাইরে কাটাতে হত না। বাড়ি ফিরে আসতে পারত!’’ পাশ থেকে ভেসে আসছে উদ্বিগ্ন এক নারী কণ্ঠও।
আরও পড়ুন: হাতের বদলে পায়ের মেডিক্যাল রিপোর্ট! কাঠগড়ায় নামী ডায়াগনস্টিক সেন্টার
প্রশ্ন করা গেল, ‘‘কোথায় নামার কথা ছিল?’’ হতাশ গলায় জবাব এল, ‘‘হাবড়া।’’ তত ক্ষণে রাতের শেষ ডাউন ট্রেন চলে গিয়েছে। এই মাত্র চলে যাওয়া আপ ট্রেনে মধ্য রাতে বাড়ি ফেরা ওই সহযাত্রীদের মধ্যে এমন কেউ চেনাও নেই, যাঁকে ফোন করে জানানো যায় বিষয়টি। এই ভাবনার মধ্যেই ও পাশের পুরুষ কণ্ঠ জানালেন, ‘‘ঠিক আছে। আপনি আর কী করবেন! আবার অন্য কারও ফোনের জন্য অপেক্ষা করি। দেখি, সে ফোন কত ক্ষণে আসে!’’
এত সব কথার পরেও ধোঁয়াশা এক ফোঁটা কাটল না। ফোনের ও পারের ভদ্রলোককে সে কথা জানানো গেল। পরবর্তী কথাবার্তায় জানা গেল, ট্রেনের ওই যুবকের নাম সুধীর ঘোষ ওরফে বিল্টু। তাঁর বুকে লেখা মোবাইল নম্বরে ফোন করে যাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছে, তিনি বিল্টুর মামা স্বপন বসু। উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়ার হিজলপুকুরে তাঁদের বাড়ি। বিল্টুদের আসল বাড়ি দত্তপুকুরে। বাবা মারা গিয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে। স্বপনবাবুর বাড়ি লাগোয়া জমিতেই তাঁর দিদি-ভাগ্নে বাড়ি করে থাকেন। দিদি বর্তমানে অসুস্থ। বছর চল্লিশের ভাগ্নে বিল্টুর এমনিতে তেমন কোনও সমস্যা নেই। শুধু একটাই নেশা তাঁর— ট্রেনে চড়া। এক বার ট্রেনে উঠে বসলে, সে আর নামতে চায় না। ট্রেন যেখান থেকে যেখানে যায়, বিল্টুও সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে থাকে।
ভাগ্নের এই ‘নেশা’র চোটে কয়েক দশক ধরে রাতের ঘুম উড়ছে বছর সাতান্নের মামা স্বপনের। বছর দশেক আগে তাই ঠিক করেন, বিল্টুর পোশাকে নিজের মোবাইল নম্বর লিখে দেবেন। তাঁর কথায়, ‘‘তাতে ওর বাড়ি ফেরার রাস্তাটা সহজ হয়।’’ কী ভাবে? স্বপনের জবাব, ‘‘এই যে ভাবে আপনার সঙ্গে কথা হচ্ছে আমার।’’ বিল্টুর সব পোশাকেই কি মোবাইল নম্বর লেখা? ‘‘হ্যাঁ, মোটামুটি ১০ সেট পোশাকে আমি এ ভাবে মোবাইল নম্বর বসিয়ে দিয়েছি। পোশাকগুলো একটু পুরনো হয়ে গিয়েছে। আবার বানাতে হবে,’’— বলছেন স্বপন। বছর ১৫ আগে স্থানীয় বাণীপুর মেলা থেকে নিজের মোবাইল নম্বর ভাগ্নের হাতে ‘উল্কি’ করিয়ে দিয়েছিলেন স্বপন। সেটা এখনও আছে বিল্টুর হাতে, তবে আবছা। সেই নম্বর দেখেও গরমকালে অনেকে ফোন করেন।
আরও পড়ুন: সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ল ছবি, কোন্নগরে বাঘের আতঙ্ক
এর আগে কবে ‘ট্রেন চড়তে’ বেরিয়েছিলেন ভাগ্নে? বিল্টুর মামার জবাব, ‘‘এই তো দিন আটেক আগে বাড়ি ফিরেছে। আবার আজ বেরিয়ে গেল!’’ প্রতি বারই কি কেউ না কেউ ফোন করে বিল্টুর ‘ট্রেন চড়া’র খবর দেন? স্বপন জানাচ্ছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কৌতূহলের বশে কেউ না কেউ ফোন করেন। কখনও ওঁর সামনে বসে থাকা যাত্রী, কখনও বা প্ল্যাটফর্মের কেউ, কখনও বা রেল পুলিশ-আরপিএফ— ফোনটা আসেই। ফোন পেয়ে স্বপনবাবু তাঁদের বিল্টুর বাড়ির ঠিকানা বলে দেন। আট দিন আগে যেমন ফোন এসেছিল গেদে থেকে। তার আগের বার ক্যানিং। একে একে শিয়ালদহ শাখার প্রায় প্রত্যেক স্টেশনের কথাই বলেন স্বপন, যেখান থেকে বিল্টুর জন্য ফোন পেয়েছেন। তবে মাঝে মাঝে একাই বাড়ি ফিরে আসেন ভাগ্নে। তাঁর কথায়, ‘‘মাঝে মাঝে ও সব কিছু ভুলে যায়। শুধু মনে থাকে ট্রেন। আর যখন ওর বাড়ির কথা মনে পড়ে, তখন চলে আসে। আসলে স্মৃতির সমস্যা।’’
স্বপনবাবুই জানালেন, এই ‘নেশা’র জন্য কলকাতায় ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তার দেখানোও হচ্ছে বিল্টুকে। ওষুধ খাচ্ছেন তিনি। কিন্তু, ট্রেনে চড়ার কোনও বিরাম নেই। এমনিতে ব্যবহারে কোনও অসঙ্গতি নেই। কথাবার্তাতেও নেই কোনও অস্বাভাবিকতা। কিন্তু ট্রেনে বসে মোদী-মমতা আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন বিল্টু, এ কথা জেনে একটু হাসলেন স্বপন। পাশের নারীকণ্ঠ এত ক্ষণ ধরে উদ্বেগে ভরা নানা প্রশ্ন করছিলেন। এ বার তাঁকেও হাসতে শোনা গেল। তিনি স্বপনের স্ত্রী। মাঝরাতে ভাগ্নের খবর পেতে জেগে রয়েছেন তিনিও? স্বপন জানালেন, বছরের বেশির ভাগ দিন-রাতই তাঁদের বিল্টুর খবরের অপেক্ষায় কাটে। তাঁর স্ত্রী বললেন, ‘‘রাস্তাঘাটের কথা তো বলা যায় না। এই শীতের রাতে ছেলেটা বাড়ির বাইরে রয়েছে, আমরা কী ভাবে ঘুমাই বলুন তো! চার দিকে যা শুনি! ও তো আবার লোকের কাছ থেকে চেয়ে খায়। যদি কখনও কারও খাবার তুলে নিয়ে খেতে যায়, যদি ওর সঙ্গে কোনও অঘটন ঘটে! তাই ঘুম আসে না।’’
কিন্তু ট্রেন সফরের সময় বিল্টু কী খাওয়াদাওয়া করেন? তাঁর কাছে কি পর্যাপ্ত টাকা থাকে? স্বপন বললেন, ‘‘পাঁচ-দশ টাকা থাকে হয়তো। ও শুনেছি বাইরে বেরিয়ে চেয়ে-চিন্তেই খায়। কারণ, অনেক বার খাবারের দোকান থেকেও ফোন পেয়েছি, এই ছেলে কি আপনাদের? টাকা চাইতেই বলেছে এই নম্বরে ফোন করতে! আসলে ছেলেটা এত মায়াময়, কেউ ওকে না করতে পারে না।’’ তবে বিল্টু পুলিশকে খুব ভয় পায়। তাঁর মামা যেমন ফোন রাখার আগে বললেন, ‘‘এ বার যদি ওকে কোথাও দেখেন, শুধু বলবেন, বাড়ি চলে যা। নইলে পুলিশকে বলে দিচ্ছি। এটা বললেই ও হয়তো বাড়ির পথ ধরত।’’
রাত তখন দেড়টা। স্বপন ফোন রাখলেন, কারণ, তাঁর মোবাইলে অন্য কেউ কল করছিলেন। আশাবাদী মামা সেই ফোন ধরতেই কেটে দিলেন এই ফোন। কিছু ক্ষণ পরে ফের ফোন করে জানা গেল, চাঁদপাড়া থেকে আরও এক জন ফোন করেছিলেন। তিনিও ট্রেন থেকে নেমে ফোন করেছিলেন। ফলে, সে রাতে বিল্টুর বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা তিনিও করতে পারেননি।
বিল্টুর কথা শুনে মনোরোগ চিকিৎসক কেদার বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এটা একটা মানসিক রোগ। তবে সেটা নানা কারণে হতে পারে। এপিলেপ্সি বা ব্রেন টিউমারের মতো বিষয়ও থাকতে পারে তার পিছনে। রোগী না দেখে বলা সম্ভব নয়।’’ আর ট্রেন চড়ার নেশা? কেদারবাবুর কথায়, ‘‘আমাদের সকলেরই অনেক রকমের ইচ্ছে হয়। আমরা সে সব ইচ্ছে নিজেদের নিয়ন্ত্রণেও রাখতে পারি। কিন্তু এই বিল্টুরা পারেন না। ওঁদের যখন যেটা ইচ্ছে করে, তখন সেটাই করে ফেলতে হয়। আসলে, কমপালসিভ। সে কারণেই উনি ট্রেনে চেপে ঘুরে বেড়ান। ওটাই ওঁর ভাল লাগে। তবে এর চিকিৎসা রয়েছে।’’
কেদারবাবুর কথা শুনে বিল্টুর মামা বলছেন, ‘‘চিকিৎসা তো আমরা করাচ্ছি কত্ত বছর ধরে। কিন্তু ওকে তো ঘরে ধরে রাখতে পারছি না। এ বার ফিরলে অন্য ডাক্তার দেখাব।’’
মামা যখন এ সব বলছেন, ‘পলাতক’ বিল্টু তখনও ট্রেন সফর শেষ করে ঘরে ফেরেননি। ‘নেশা’ কাটিয়ে ফের তিনি কবে ফিরবেন, অপেক্ষায় কাটান স্বপনরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy