প্রতীকী ছবি।
সুন্দরী গাছের মতোই মাটি আঁকড়ে থাকেন ওঁরা। সে কারণেই সুন্দরবন অঞ্চলে বার বার দুর্যোগ ওঁদের মনোবল ভাঙতে পারে না। ওঁরা স্থিতিস্থাপক। এমনই মত অধিকাংশ মনোরোগ চিকিৎসক ও মনোবিদের। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই টানা মাস ছয়েক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থেকেও তাঁরা মাছ ধরা, বাঁধ তৈরি, পুকুরের নোনা জল বার করে ফের তা মাছ চাষের যোগ্য করার কাজ করে যান। সেই ওঁদেরই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন চিকিৎসকদের একটি অংশ।
কারণ, আমপান পরবর্তী হাতে গোনা মানসিক স্বাস্থ্য শিবিরে ভিড় করা রোগীদের সকলেই অনিদ্রা, অবসাদ, প্যানিক অ্যাটাক, ডিসোসিয়েটিভ ডিজ়অর্ডারের (ঘুমের মধ্যে শ্বাস আটকে যাওয়ার ভয়, নকল মৃগি, নকল প্যারালিসিস, ঘন ঘন সংজ্ঞা হারানো) মতো সমস্যার শিকার। আগে যা এত বেশি নজরে আসেনি বলেই জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
আমপান বিপর্যয়ের দু’মাস পেরিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে সুন্দরবন অঞ্চলে বিভিন্ন ব্লকে বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্য শিবির হলেও শুধু মানসিক স্বাস্থ্যের শিবির যে অনেক কম হয়েছে, মানছেন চিকিৎসকেরা। নামখানা ব্লকে তিন-চারটি শিবির করেছেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট প্রশান্তকুমার রায়। তাঁর কথায়, “অবসাদ, অনিদ্রা, প্যানিক অ্যাটাকের মতোই ডিসোসিয়েটিভ ডিজ়অর্ডারের সমস্যা নিয়ে আসা বহু রোগী পেয়েছি। আসলে গ্রামীণ সমাজে মানসিক চাপ গ্রাহ্য হয় না। কিন্তু মন তা প্রকাশ করার প্রক্রিয়া খোঁজে। সেই প্রক্রিয়ায় যখন শরীর অংশ নেয়, তখন তা ডিসোসিয়েটিভ ডিজ়অর্ডার রূপে প্রকাশ পায়। তখনই তা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।”
আমপান আর লকডাউনের জোড়া ফলায় এই সব সমস্যা বেড়েছে। কারণ, ঘুরে দাঁড়ানোর রাস্তাই হারিয়ে গিয়েছে। পানের বরজের এক চাষি জানাচ্ছেন, আমপানে তাঁর ন'টি বরজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ন'হাজার পান বাঁচিয়ে তা বিক্রি করে পেয়েছিলেন ২০৮ টাকা। যা বাজারে নিয়ে যেতে খরচ হয়েছিল ১৪০০ টাকা! অবসাদগ্রস্ত সেই চাষির নিত্যসঙ্গী অনিদ্রা। নামখানার শিবিরে আসা নারায়ণপুরের অবসাদগ্রস্ত তিন কলেজছুট চিকিৎসকদের বলেছিলেন, স্মার্টফোনের অভাবে তাঁরা অনলাইন ক্লাস করতে পারছিলেন না। এর মধ্যেই এল ঝড়। পরিবার বাঁচাতে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে স্থানীয় বাজারে মোটবাহকের কাজ নিয়েছেন ওঁরা।
সুন্দরবনে বছরভর মনোরোগের চিকিৎসা করেন বিষাণ দত্ত। তাঁর কথায়, “আমার রোগীদের বেশির ভাগই স্কিৎজো়ফ্রেনিয়া, অবসাদ, বাইপোলার ডিজ়িজে ভোগেন। ওষুধে ছেদ পড়লেই সে সব বেড়ে যায়। অথচ ওঁরা ওষুধ নিতে মার্চের পর থেকে আসছেন না।” ফলে ফের বাড়ছে পুরনো মনোরোগীদের অসুখও।
আয়লার পরে ইউনিসেফের সহযোগিতায় গোসাবা, হিঙ্গলগঞ্জ, পাথরপ্রতিমা প্রভৃতি অঞ্চলে সমীক্ষা করেছিল এই শহরের মনোরোগ সংক্রান্ত একটি সংস্থা। ধরা পড়েছিল ধ্বস্ত শিশুমন। সংস্থার তরফে মনোবিদ মোহিত রণদীপ জানাচ্ছেন, আতঙ্কের পরিবেশে জন্ম নেওয়া মানসিক চাপ থেকে শিশুদের বার করা জরুরি। খেলাধুলো, ছবি আঁকা বা বিভিন্ন দলগত কাজের মাধ্যমে তা প্রকাশ পেতে পেতেই কমে যায়। সে সব নিয়ে এ বারে ভাবা উচিত বলেই তাঁর মত।
দীর্ঘ দিন ধরে ওই এলাকায় চিকিৎসা করতে যাচ্ছেন কমল সাহা। তাঁর বক্তব্য, পেশাগত কারণে ওই বাসিন্দাদের ঝুঁকি ও অসুখের সঙ্গে লড়তে হয়। অথচ কয়েক মাইল দূরত্ব পেরিয়েও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দেখা মেলে না! তাঁর কথায়, “এত বঞ্চনা সহ্য করতে হলে তো মানসিক চাপ হবেই। অবহেলায় তা রোগে পরিণত হবে, যেটা হচ্ছেও। বড় বিপর্যয়ে ওঁদের দিকে সাময়িক দৃষ্টি পড়ছে। ওঁদের মন ভাল রাখতে দীর্ঘ পরিকল্পনা জরুরি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy