Advertisement
E-Paper

‘বাড়া ভাতেও ছাই পড়ে আমাদের!’

গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের লটিয়াবনি, রাধাকৃষ্ণপুর, জামগাড়ির মতো গ্রামের বাসিন্দারা জানেন, ছাই-দূষণের সমস্যা কাকে বলে।

সবুজ যখন কালো। বাঁকুড়ার মেজিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র লাগোয়া লটিয়াবনিতে।

সবুজ যখন কালো। বাঁকুড়ার মেজিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র লাগোয়া লটিয়াবনিতে। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২১ ০৬:১৪
Share
Save

গ্রামের হরিমন্দির চত্বরে খেলতে ব্যস্ত নিজের বছর আটেকের ছেলেকে দেখিয়ে লটিয়াবনির উত্তম মণ্ডলের খেদ, ‘‘খেলাচ্ছলে ওর মতো বাচ্চারা প্রায়ই হাতে, মুখে পথে-ঘাটে পড়ে থাকা ছাইয়ের গুঁড়ো মাখে। এটা যে কত বিপজ্জনক, বোঝে না!’’

বাচ্চারা বোঝে না। কিন্তু বাঁকুড়ায় ডিভিসি-র মেজিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র লাগোয়া গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের লটিয়াবনি, রাধাকৃষ্ণপুর, জামগাড়ির মতো গ্রামের বাসিন্দারা জানেন, ছাই-দূষণের সমস্যা কাকে বলে। তাঁদের অভিযোগ, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই-পুকুর (অ্যাশ পন্ড) থেকে উড়ে আসা ছাইয়ে ঘর ভরে যায়। গাছের সবুজ পাতা ছাই জমে কালো হয়েছে। পুকুরে ছাইয়ের ‘সর’ পড়ায় স্নান করা যায় না। ঘাসের উপরে জমা ছাই খেয়ে গবাদি পশুরা রোগে ভোগে। বর্ষায় ছাই-পুকুরের পাড় ক্ষয়ে ছাই উপচে নষ্ট হয় চাষ-জমি। রাধাকৃষ্ণপুরের ফটিক লায়েক, লটিয়াবনির বিশ্বনাথ মণ্ডলদের ক্ষোভ, ‘‘ঘরের পাশের এই দূষণের জন্য বাড়া ভাতেও ছাই পড়ে আমাদের!’’

কেন্দ্রীয়, রাজ্যের অধীন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এবং বেসরকারি ক্ষেত্র মিলিয়ে রাজ্যে ১৬টি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী রত্না দে নাগ জানান, তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিতে ‘ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক প্রেসিপিটেটার’ (ইএসপি) যন্ত্র বসিয়ে চিমনি থেকে ছাই এবং ধূলিকণা বেরোনো অনেকটাই আটকানো গিয়েছে। ছাইকে সিমেন্ট এবং ইট তৈরির কাঁচামাল হিসেবে রফতানি করতে বলা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য-জল শোধনের কেন্দ্র গড়া হয়েছে। মন্ত্রীর দাবি, বিদ্যুৎকেন্দ্র লাগোয়া এলাকায় স্বয়ংক্রিয় বায়ু দূষণপরিমাপক যন্ত্রের সাহায্যে দূষণের মাত্রার উপরে এবং ছাই-পুকুরের পরিস্থিতি নিয়মিত নজরে রাখা হয়। কোনও বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ম না মানলে বা দূষণ ছড়ালে, রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ জরিমানা-সহ নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়।

তাতে কি সমস্যা মিটেছে?

পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে ডিভিসি-র বিদ্যুৎকেন্দ্র লাগোয়া ভালডুবি, রায়বাঁধের মতো গ্রামের বাসিন্দারা ভিন্ন মত। তাঁদের অভিযোগ, মাঝেমধ্যে ওই কেন্দ্রে ‘ইএসপি’ বন্ধ রেখে উৎপাদন করা হয়। ‘কোল হ্যান্ডলিং প্ল্যান্ট’ থেকেও কয়লার গুঁড়ো ছড়ায়। এলাকার ‘জমিহারা কমিটি’র নেতা চিন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার গুঁড়ো ও ছাইয়ের সমস্যা প্রশাসনকে জানিয়েছি।” ইএসপি বন্ধ রাখার অভিযোগ উড়িয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ‘হেড অফ দ্য প্রজেক্ট’ তরুণ কুমার বলেন, “মাঝে নিম্ন মানের কয়লা আসায় কিছু সমস্যা হয়েছিল। এখন তা নেই। দূষণ রুখতে আমরা সজাগ।”

এলাকাবাসীর অভিযোগ, পুরুলিয়া সাঁওতালডিহিতে পিডিসিএল-এর তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই থেকে স্থানীয় কদমদা জোড়ের (ছোট নদী) জল দূষিত হচ্ছে। যদিও বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার সুস্নাত আইচের বক্তব্য, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই ট্রাকে-ডাম্পারে ভিন‌্-রাজ্য ও বাংলাদেশে যায়। কয়েক মাস আগে সেই গাড়িগুলি সাফাই করতে গিয়ে ছাই বাইরে ফেলা হয়েছিল। বৃষ্টিতে ধুয়ে তা গিয়ে পড়ে কদমদা জোড়ে। তাঁর দাবি, ‘‘গাড়ির মালিকদের সর্তক করা হয়েছে। জরিমানাও করেছি।”

সাগরদিঘি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র লাগোয়া মনিগ্রামেও বাড়ির ছাদ, গ্রামের মাঠ ছাই জমে কালো। ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৬৬০ মেগাওয়াটের একটি নতুন ইউনিটের কাজ চলছে। গ্রামের বাসিন্দাদের আশঙ্কা, ‘‘আরও ছাই বাড়লে হয়তো গ্রামে থাকাই দায় হবে।’’ মুর্শিদাবাদেই এনটিপিসি-র ফরাক্কার তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে বছরে প্রায় ৩৬ লক্ষ টন ছাই তৈরি হয়। ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের দু’টি ছাই-পুকুর ইতিমধ্যে ভরাট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু লাগোয়া গ্রাম নিশ্চিন্দ্রার বাসিন্দাদের বাধায় গত পাঁচ বছর ধরে সেখানে নিজস্ব জমিতে তৃতীয় ছাই-পুকুর গড়তে পারছে না এনটিপিসি।

কেন বাধা?

নিশ্চিন্দ্রার বাসিন্দা অমল মিশ্রের দাবি, ‘‘গ্রীষ্মে গ্রামের ছাই-পুকুর থেকে উড়ে আসা এবং পরিবহণের সময় ট্রাক-ডাম্পার থেকে ওড়া ছাইয়ের দূষণে ক্ষতি হচ্ছে সবার। আর একটা ছাই-পুকুর হলে, পরিবেশ আরও বিষিয়ে উঠবে।’’ এ ব্যাপারে তৃণমূল, সিপিএম এবং কংগ্রেসের নেতারাও পাশে দাঁড়িয়েছেন নিশ্চিন্দ্রাবাসীর।

ছাই-পুকুর থেকে ওড়া ছাই নিয়ে একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাট, পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুরে। বিধির পরোয়া না করে ট্রাকে-ডাম্পারে বজবজ তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই পরিবহণের অভিযোগ রয়েছে পুজালি ও বজবজ পুরসভা এলাকায়। এক সময়ে হুগলির ব্যান্ডেল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের (বিটিপিএস) ছাই থেকে বায়ু এবং জল দূষণের অভিযোগ উঠত। পরিবেশবিদ বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘বিটিপিএস-এর দূষণের পরিমাণ অনেক কমলেও নির্মূল হয়নি। ছাই নিয়ে যাওয়ার সময় যথাযথ ঢাকার বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার।’’

মেজিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের চিফ ইঞ্জিনিয়ার সঞ্জয়কুমার ঘোষ জানান, বাতাসে ছাই ওড়ার সমস্যা রুখতে ছাই-পুকুরে নিয়মিত জল দেওয়া হয়। বর্ষার সময় থেকে সে কাজ বন্ধ ছিল। সম্প্রতি শুরু হয়েছে। ছাই-পুকুরের পাড় পোক্ত ও উঁচু করা হবে। তাঁর আশ্বাস, ‘‘দূষণ রুখতে সব চেষ্টা হচ্ছে।’’

‘‘না আঁচালে বিশ্বাস নেই’’, ছেলের হাত-মুখ থেকে ছাই মোছাতে মোছাতে বলেন লটিয়াবনির উত্তম মণ্ডল। তাঁর সংযোজন: ‘‘না জানি, দূষণে শরীরের কত ক্ষতি হয়েছে এর মধ্যে!’’

Mejia Thermal Power Station Pollution

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}