পঞ্চমীর সকালে মানসিক রোগাক্রান্তদের আলাদা করে চেনার বদভ্যাস পাল্টানোর পাঠ দিল শহরের এক মানসিক স্বাস্থ্য অধিকার সংগঠন।
পুজো শুরু আমাদের। ‘ওঁদের’ না, ‘আমাদের’। কারণ, ‘ওঁরা’ আসলে ‘আমরাই’। পঞ্চমীর সকালে মানসিক রোগাক্রান্তদের আলাদা করে চেনার বদভ্যাস পাল্টানোর পাঠ দিল শহরের এক মানসিক স্বাস্থ্য অধিকার সংগঠন। পাভলভ ও লুম্বিনি পার্ক মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রের চিকিৎসাধীনরা বছরে দু’বার হাসপাতালের চার দেওয়াল ছেড়ে বেরতে পারেন। দুর্গাপুজো আর পিকনিকে। গত বছর কোভিডের তাড়নায় তাও হয়নি। দু’দফা টিকাকরণের পর তাই এ বছর পঞ্চমীর সকালে হাসপাতালের চেনা রুটিন ছেড়ে বেরলেন আবাসিকরা। সঙ্গী হলেন শিল্পী বন্ধু, এক ঝাঁক শুভাকাঙ্ক্ষী। প্রথমে বালিগঞ্জ, পার্ক সার্কাস হয়ে ম্যাডক্স স্কোয়্যার, শেষে পুজোর খাওয়ায় স্বাদ বদল, আয়োজন ছিল পরিপাটি।
সাতটি বাসে মোট ৭০ জন আবাসিক। সবার গায়ে পুজোর নতুন জামা। রবিবারের বেলা তখন সবে পড়তে শুরু করেছে। পার্ক সার্কাস ময়দানের কাদা আর ঘাস পেরিয়ে যখন সকলে ঠাকুর দেখতে যাচ্ছেন, তখন দেখে মনে হচ্ছিল কতগুলো ফুল যেন হেঁটে চলেছে একাগ্রভাবে। কী প্রবল নিয়মানুবর্তিতা! সবই তো স্বাভাবিক, সুস্থ। সুস্থতার সব গুণই তো স্পষ্ট। তা হলে? কেন ‘ওঁরা-আমরা’ করে রাখা?
ঘটনাচক্রে পঞ্চমীর দিনটি ছিল মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। মনোবিদ তথা সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় বললেন, ‘‘জানেন তো, লড়াইটা এখানেই। আমরা একটাই প্রশ্ন করতে চাই, কেন মানসিক রোগাক্রান্তদের এমন সমাজ বহির্ভূত করে দেওয়া হবে? কেন ‘ওঁদের’ ‘আমাদের’ করে নেওয়া হবে না? আমরা দীর্ঘ দিন এই কাজের সঙ্গে জড়িত। এমনও দেখেছি, সাম্যর বড় অভাব। সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরে অনেক আবাসিকের বাড়ির লোক ফিরিয়ে নিতে চান না। কেন? হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর আমরা কি পরিবারের মানুষটিকে ফিরিয়ে নিই না? তিনি কি কাজে যোগ দিতে পারেন না? তা হলে এখানে কেন এমন বিচার?’’
যাত্রা পথের মধ্যেই বাসে পৌঁছে গেল সকালের খাবার। এক শিল্পী বন্ধু, যাঁর পরিকল্পনায় চলে নাটকের ক্লাস, তিনি এলেন মাঝপথে। আবাসিকদের মধ্যে এক জন ডেকে উঠলেন, “সাগ্নিক দা! কত দিন পর দেখলাম।” এ তো হৃদয়ের আহ্বান। কেউ আবার মাঝপথে জানতে চাইলেন ফাইন আর্টস পড়ে ঠিক কী হয়, কেউ আবার ঠাকুর দেখে বন্ধুর কানে বলে ফেললেন, “ওই দেখ। সিংহ। দেখ, অসুরকে কেমন কামড়ে ধরেছে।” সাগ্নিক মুখোপাধ্যায় এই আবাসিকদের নাট্যবন্ধু। তিনি বললেন, “আমি প্রথম যখন এখানে কাজ করতে আসি, অনেক ভেবে পা ফেলতে হয়েছিল। ওঁরা সংলাপ মনে রাখতে পারেন না। প্রথমে মুভমেন্ট নির্ভর নাটক করিয়েছিলাম। দৃশ্য তৈরিতে আবাসিকদের ‘প্রপ’-এর মতো ব্যবহার করতাম। পরে ধীরে ধীরে সংলাপ দেওয়া নাটকে আসি।”
“আমি তো থিয়েটারের গেম খেলাই এখনও। মগজ আর শরীর যাতে এক সঙ্গে কাজ করে, তার অনুশীলন করাই,” বললেন অপর নাট্যবন্ধু মোম ভট্টাচার্য। সংগঠনের কার্যনির্বাহী পদাধিকারী শুক্লা দাস বড়ুয়ার বক্তব্য, “গত বছর বেরতে পারেননি বলে আবাসিকরা দুর্গা বানিয়েছিলেন, কী সুন্দর সেই সৃষ্টি। ওঁরা চায়ের ঘর বলে একটি ক্যান্টিন তৈরি করেছেন, ওঁরাই চালান।” অপূর্ণতা নেই? আছে। শুক্লা বললেন “অনেককে সুস্থ করেও ফেরত পাঠানো যায় না। বাড়ির লোক নিতে চান না। অনেকে ভুল ঠিকানা দিয়ে ভর্তি করে দিয়ে যান, যাতে পরে আর কেউ খোঁজ করতে না পারে।’’
যে হাসি কেড়ে নেওয়া যায় না, সেই হাসির মূলধন বুকে চেপে মগজে যাঁদের হাস্নুহানা ফোটে রোজ, তাঁরাই কি পাগল? রত্নাবলী প্রশ্ন করেছিলেন, “পাগল বলতে মানুষ যা বোঝে, তেমন কোনও ব্যবহার দেখলেন?” নাহ, তেমন কোনও লক্ষণ নেই। বরং যেন একটা স্কুল ছুটির আনন্দ আছে। পাভলভের সুপার গণেশ প্রসাদের সঙ্গে কথা হল যখন, তখন মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজন চলছে। তিনি বললেন, “আবাসিকরা যে পুজোর সময় বেরতে পেরেছেন, ভাল লাগছে দেখে। খুব আনন্দ হচ্ছে। সকলে দু’টি টিকা পেয়েছেন, করোনা বিধি মেনে আজ দিনটা আনন্দ করছেন।’’ দিন শেষ হল সেই পেটপুজোর আনন্দেই।
রবিবার ঠাকুর দেখা সেরে আবারও সকলে ফিরে গেলেন নিজের চেনা কুঠুরিতে। রাত-দিন ওষুধ, চেনা বৃত্তের সুখ-অসুখের জীবনে একই ভাবে দিন কাটতে থাকবে হয়তো। কেউ ফিরে যাবেন, কেউ থেকে যাবেন। শুধু ছাঁকনির তলানির মতো লেগে থাকবে এই পুজোর পঞ্চমী। প্রিয়জনের সাক্ষাৎ, বন্ধুর আলিঙ্গন আর অচেনা এক ছোকরাকে মানসিক হাসপাতালের চিকিৎসাধীন এক মানুষের শংসাপত্র , “ইউ আর নট আ ওয়াইজ ম্যান।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy