নতুন জামা নিয়ে আমার ভারি এক উত্তেজনা ছিল বরাবর।
মেয়েবেলার পুজো...
একেবারে ছোটবেলায় পুজোর অভিজ্ঞতা বিশেষ মনে নেই। সারা বছরে কেবল পুজোর সময়েই বাবা টানা এত দিন ছুটি পেতেন। ফলে এই চারটে দিন আমাদের জন্য ছিল বেড়াতে যাওয়ার ছুতো। পুরী, দিঘা, ঘাটশিলা — মধ্যবিত্ত বাঙালির যাবতীয় ছুটির ঠিকানা আমরা চষে ফেলেছিলাম। এই রুটিনের অদলবদল হল ক্লাস সেভেনে। তখন আমি সামান্য বড়। কেন ঘুরব আর মা বাবার সঙ্গে? সেই বছর থেকে গেলাম বাড়িতেই, বন্ধুদের সঙ্গে ছুটি কাটাব বলে। সেই প্রথম কলকাতার দুর্গাপুজো দেখা। একটু বড় হয়ে এল পুজোয় প্রেম। সে এক দারুণ রোম্যান্টিক ব্যাপার। আমার বয়সী আর পাঁচ জনের যেমন পুজোয় প্রেম নিয়ে অভিজ্ঞতা আছে, আমারও তেমনই। এ ছাড়া প্রতি বছর যেতাম বাবার মামা বাড়ি ও মায়ের মামা বাড়িতে। দুই বাড়িতেই পুজো হয়। সেখানে যাতায়াতের পর থেকে পুজো খানিক বদলে গেল। তখন পুজো মানে এক বাড়ি ভর্তি লোকজন, ভাই-বোনের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া... অনাবিল এক আনন্দের সুখ-স্পর্শ ছিল সে সব দিনে।
পুজো মানে এনবিএ-র স্টল
যখন ছোট ছিলাম, পুজোর ক’দিন মা-বাবাকে দেখতাম প্যান্ডেলের পাশে মার্ক্সবাদী স্টলে বসতে। আমিও মা-বাবার সঙ্গেই বসতাম। উৎসবের আনন্দেও সেই স্মৃতি আমার বামপন্থী চেতনাকে প্রচ্ছন্নে আকার দিয়েছে। এখনও স্টলে বসি। পুজোয় ঘোরাঘুরির খুব একটা চল বাড়িতে কোনও দিনই ছিল না। মা বাবা কোনও দিন পুজোর জামা কিনে দেননি, এমনকি জন্মদিনেও না। তবে আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে আমিই ছিলাম সবচেয়ে ছোট, ফলে নতুন জামার অভাব ঘটেনি পুজোয়। আর নতুন জামা নিয়ে আমার ভারি এক উত্তেজনা ছিল বরাবর। সেই উত্তেজনা শীর্ষে পৌঁছত পঞ্চমীর দিন, কারণ সারা বছরের মধ্যে এই এক দিনই কেবল ইস্কুলে আমাদের রঙিন জামা পরার ছাড় ছিল। শহরের আকাশে তখন উৎসবের চাঁদোয়া। রাংতায় মোড়া চেনা রাস্তা ভুল হচ্ছে অচেনা বলে। মাইক বাজছে পাড়ায় পাড়ায়। সামনের ১০-১২ দিন পড়াশোনা থেকে মুক্তির আনন্দ... আর মনের মধ্যে প্রজাপতি!
প্রবাসে পুজো
পুজোর মানে অনেকটাই বদলে গেল জেএনইউ-য়ে যাওয়ার পর। মনে আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরে প্রথম যে কাজটি আমি করেছিলাম, তা হল পুজোয় কলকাতার টিকিট কাটা। সেই বছর প্রথম বার পুজোয় কলকাতার ‘ফিরতে’ হল আলাদা করে। ২০১৩ সালের এই পুজোর মতো তাই আর কোনও পুজোয় এত অপেক্ষা ছিল না, ছিল না এতটা আকুলিবিকুলি। পরের বছর কলকাতা আসতে পারিনি বলে বাড়ির লোকজনই দিল্লি গিয়েছিল, যাতে পুজো একা না কাটাতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপিকার একটি সাংস্কৃতিক দল ছিল। সেই দলের হয়ে সে বার দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় নাচ-গান-আবৃত্তির একটি কোলাজ করেছিলাম ষষ্ঠী আর সপ্তমীতে। নিজের বাড়ি থেকে তখন অনেক দূরে। তবু এই অনুষ্ঠানের মধ্যেই ফিরে পেয়েছিলাম ছোটবেলায় পুজোয় দলবেঁধে নাটক, নাচ, গানের আনন্দ। রাজধানীতে পুজোর সংখ্যা একেবারেই সীমিত। তাই একটা অপূর্ণতা থেকেই যায়। কিন্তু সেই হাতে গোনা পুজোতেই উপচে পড়ে বাঙালির ঢল। কলকাতা থেকে এত দূরেও যেন এক টুকরো কলকাতা, ঘর থেকে এত দূরেও এক চিলতে ঘর...
বামপন্থা উৎসব-বিমুখ করেনি আমায়
যাঁরা এত দূর পড়ে বামপন্থা ও পুজোর মধ্যে বিরোধ খুঁজছেন, তাঁদের বলি— পুজোর কোনও ধর্মীয় গুরুত্ব না থাকলেও বিরাট এক সামাজিক গুরুত্ব আছে আমার কাছে। বিশেষ করে এই অতিমারির সময়ে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতায় পুজোর চার দিন সব কিছু ফেলে সকলের সঙ্গে মিলিত হওয়ার গুরুত্ব আরও বেশি। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। আজ যখন সে অনেক বেশি একা, অন্তর্মুখী— তখন একসঙ্গে ফুচকা খাওয়া, মোমবাতি জ্বালানোর প্রতিযোগিতা বা নাচ-গান করাও ভীষণ মূল্যবান। ধার্মিকতা ও সামাজিকতার মধ্যে বেশ খানিক দূরত্ব আছে। যাঁর পেটে রোজ ভাত জোটে না, তিনিও উৎসবের কয়েক দিন খোঁজেন আশ্রয়, চেষ্টা করেন বাড়ি ফিরে ছেলেমেয়ের হাতে একটা নতুন জামা তুলে দিতে। শহরের আলোকময় প্রচার-প্রদর্শনীর অন্তরালে এক দল মানুষ নীরবে চেষ্টা করে যান দৈন্যের মধ্যেও নিজেদের মতো করে ভাল থাকতে। এই ক’দিন যে উৎসব! ধর্ম একেবারে ব্যক্তিগত বিষয়। আমরা যাঁরা বামপন্থী, তাঁরা ধর্মকে সামনে রেখে সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার বিরোধী, ব্যক্তিগত পরিসরে ধর্মাচরণের বিরোধী নই। আমরা যে সমাজে বাস করি, তাতে সবার পেটে ভাত নেই, সবার হাতে কাজ নেই। এমন এক সমাজে আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য কি সকলকে ধর্ম-বিমুখ করে তোলা, নাকি ভাতের জোগান, কাজের জোগান?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy