ছবি এএফপি।
গঙ্গার ইলিশের স্বাদ-মহিমা বুঝতেন কমলকুমার মজুমদার। সে-কালে কোম্পানির জাহাজের তেল খেয়েই বুঝি তার স্বাদে এমন খোলতাই হত!
ইলিশ কোন ঘাটের, তা শুনেই বেমালুম স্বাদ বলে দিতে পারতেন সাবেক কলকেতার গিন্নিবান্নিরাও। তক্তাঘাটের হলে চিবোতে জিভে চড়া পড়বে। বাগবাজারে মা সিদ্ধেশ্বরীর পা-ধোয়ানি জল খেয়ে ফেটে বেরোবে লালচে গ্ল্যামার। ঢের জল বয়ে গিয়েছে সেই গঙ্গা দিয়ে। গাঙ্গেয় ইলিশেরও দিন গিয়েছে। পুজোর মুখে পদ্মার ইলিশের বোধনের দিকেই তাই তাকিয়ে এ-পারের বাঙালি।
বুধবার খাস গড়িয়াহাটের বাজারে সেই রজতকান্তি মৎস্যকুলতিলকের দেখা মিললেও সংশয়ের শেষ নেই। পোড়খাওয়া ‘ভূতোদা’র ছেলে সমীর ঘোড়ুইয়ের কাছে ৬০০-৭০০ গ্রাম থেকে কিলোটাক ওজনের ‘পদ্মার অতিথি’। প্রতি কিলোগ্রামে দক্ষিণা কমবেশি হাজার টাকা। গৌর সাহার কাছে কেজি-পিছু দক্ষিণা, হাজার দেড়েক। কানাঘুষো, ডায়মন্ডের মাছের (ডায়মন্ড হারবার বা সাগর) মধ্যেও দু’চার পিস পেল্লায় ইলিশকে ‘বাংলাদেশি’ বলে চালানো হচ্ছে। কে খাঁটি পদ্মাবাসী বা বাংলাদেশি? পারলে সদ্য বাজারে হাজির ইলিশের জন্যও রাজ্যে ‘এনআরসি’ তৈরি হয়!
এ বার কলকাতা-শিলিগুড়িতে পদ্মার ইলিশ আমদানির রূপকার, হাওড়ার ডাকসাইটে ইলিশ-কারবারি সৈয়দ আনোয়ার মাকসুদের চোখে, ‘‘সাগরের ইলিশ লম্বা-পাতলা। বাংলাদেশি ইলিশ মোটা, গোল ভাব। পদ্মার ইলিশের ‘গ্লেজ়’ই (জৌলুস) আলাদা।’’ শুনে হাসেন বাঙালির ইলিশপ্রেমের ত্রিকালদর্শী সাক্ষী অমলেশ চৌধুরী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞানের এই অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের মতে, “ইলিশই নেই গঙ্গায়, তার আবার রূপগুণ!’’ লবণচর্চিত দেহে সমুদ্রের তলদেশের মহাপ্রতাপশালী মাছেদের মিষ্টি জল-অভিযানের কথা সবিস্তার লিখেছেন বুদ্ধদেব বসুও। অমলেশবাবুর মতে, ‘‘বাইরের রূপে ইলিশের ফারাক বোঝা কঠিন। তবে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে সাগর থেকে নদীর মিষ্টি জলে ঢুকলে ইলিশের অন্তর-বাহিরে নানান পরিবর্তন ঘটে যায়। তাতেই ইলিশের স্বাদ-রহস্য।’’
সাগর থেকে নদীমুখী মৎস্যপ্রবরেরা এই বর্ষায় গঙ্গাবিমুখ হওয়ায় হাহুতাশ শোনা যাচ্ছে বহু দিনই। ইলিশ মেঘনা হয়ে বাংলাদেশে ঢুকলেও পশ্চিমবঙ্গের বিধি বাম। ফলে কার্যত পথে বসেছেন এ-পারের মৎস্যজীবীরা। ইলিশের এই বিচিত্র খেয়াল নিয়ে ঘুরেফিরে ধীবরদেরই দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞেরা। মোহনার মুখেই এখন মাছধরা জালের ব্যূহ। মেঘনার মোহনায় তবু চলাচলের পথ ধরছে ইলিশ। এ তল্লাটে ‘ইলিশ করিডরটারই’ কার্যত অস্তিত্ব নেই বলে জানাচ্ছেন অমলেশবাবু। বঙ্গোপসাগরে গঙ্গার মোহনার সঙ্গে মেঘনার মোহনার তুলনাই হয় না। সাগরের কাছে মোহনা ৩০ কিলোমিটার চওড়া। হলদিয়া, ডায়মন্ড হারবার, বজবজ থেকে বাগবাজার— ক্রমশই তা ছোট হচ্ছে। আর মেঘনার মোহনা থেকে বরিশালের মুখ পর্যন্ত পৃথিবীর সব থেকে বড় মোহনা। অন্তত ১২০ কিলোমিটার চওড়া। ফলে বাংলাদেশে ইলিশ-শিকারের হিড়িক যেমন আছে, ইলিশের পদ্মামুখী হওয়ার পরিসরও পর্যাপ্ত।
সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’ সাক্ষী, এই সে-দিন মাঝভাদ্রেও খুলনার ইটিন্ডা থেকে মৎস্যজীবীরা কলকাতার গঙ্গায় পাড়ি দিতেন মাছ ধরতে। তবে তাঁদের বাহন যন্ত্রচালিত বোট নয়। বোট-পিছু ইলিশ-শিকারের সংখ্যা তখন ছিল ঢের কম। এখন ইলিশের গঙ্গায় ঢোকার সুযোগই নেই। ফরাক্কায় বাঁধ তৈরির পর থেকেই ভাগীরথীতেও ইলিশ-স্রোত কমেছে। ‘‘আগে নদীর গভীরতা ছিল। মিষ্টি জলের প্রবাহটা এখানেই ভাল ছিল। এখন নেই। উল্টে দূষণ বেড়েছে। ফলে পদ্মার কাছে গঙ্গার ইলিশের হার অনিবার্য,’’ বলছেন অমলেশবাবু।
ফিশ ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের কর্তা আনোয়ার কৃতজ্ঞ এ দেশের শুল্ক দফতরের সহযোগিতার জন্য। তিন দিনে ১৫০ টন ইলিশ ঢুকেছে ইতিমধ্যেই। বাঙালি চেন রেস্তরাঁর কর্তা রাজীব নিয়োগীর আশা, ‘‘পরে মাছের দাম খানিক পড়বে। তখন টনখানেক ইলিশ নিয়ে রাখব। পুজো বা বিজয়ার পরেও অতিথিরা খুশি হবেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy