গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
আরজি কর আন্দোলনের গোড়ায় পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি বাংলাদেশের স্লোগান থেকে ‘অনুপ্রাণিত’ হয়েছিল। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী থেকে সিপিএমের ছাত্র-যুবরা স্লোগান দিচ্ছিলেন— ‘দফা এক, দাবি এক, মমতার পদত্যাগ’। যে ভাবে বাংলাদেশে স্লোগান উঠেছিল, ‘দফা এক দাবি এক, হাসিনার পদত্যাগ’।
সেই আরজি কর আন্দোলন এখন অতীত। নিস্তরঙ্গ। প্রায় শেষ। কিন্তু বাংলাদেশে সন্ন্যাসী গ্রেফতার, তার পরে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার অভিযোগ এবং তাদের ‘বিপন্নতা’কে ‘অস্ত্র’ করে বাংলার বিরোধী দলগুলি নতুন করে আন্দোলনের রাস্তায় নামতে চাইছে। ‘অঙ্ক’ আঁচ করে শাসক তৃণমূলও অবস্থান নিয়েছে। তবে তা খানিক ‘এলোমেলো’ বলে দলেরই অনেকে মনে করছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক দিকে যেমন বলেছেন, তিনি বিদেশের (এক্ষেত্রে বাংলাদেশ) বিষয় নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থানই মেনে নেবেন, তেমনই আবার বিধানসভায় দাবি তুলেছেন বাংলাদেশে রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিবাহিনী পাঠানোর। অর্থাৎ, এ পারের সংখ্যালঘু ভোটের সঙ্গে তাঁর হিসাবে ও পারের সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্কও যে নেই তা নয়। আশ্চর্য নয় যে, তিনি বারংবার বলছেন, ‘‘আমরা সকলকেই ভালবাসি।’’
প্রত্যাশিত ভাবেই বাংলাদেশকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের মতো করে লাভের হিসেব কষতে শুরু করে দিয়েছে। বিশেষত, বিরোধী পরিসরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলির রাস্তায় নামা এবং আন্দোলনে থাকার ‘তাগিদ’ চোখে পড়ছে। অনেকের মতে, তাতে ‘অক্সিজেন’ দিচ্ছে বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে ভারতের প্রচারমাধ্যমের একাংশের ভূমিকাও। তাতে যেমন স্বাভাবিক নিয়মে বিজেপি রয়েছে, তেমনই রয়েছে সিপিএম-কংগ্রেসও। আনুষ্ঠানিক ভাবে অঙ্কের কথা না মানলেও একান্ত আলোচনায় প্রত্যেক শিবিরের নেতারা তাঁদের ‘ফর্মুলা’র কথা গোপন করছেন না।
পদ্মের অঙ্ক
২০১৯ সালের লোকসভা, ২০২১ সালের বিধানসভা কিংবা ছ’মাস আগে হয়ে যাওয়া আরও একটি লোকসভা ভোটে বঙ্গে বিজেপির রাজনীতির মূল অস্ত্রই ছিল ‘মেরুকরণ’। তার সঙ্গে জুড়ে ছিল দুর্নীতি এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ। কিন্তু ২০১৯ সালে হঠাৎ পাওয়া সাফল্য পরবর্তী কালে আর ধরে রাখতে পারেনি তারা। সেই বিজেপি বাংলাদেশে ‘হিন্দুদের উপর অত্যাচার’ নিয়ে সরব। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তো বটেই, সহায়ক হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির নেতৃত্বও ধারাবাহিক কর্মসূচি নিচ্ছেন। সমান্তরাল ভাবে চলছে সমাজমাধ্যমের প্রচার। আনুষ্ঠানিক ভাবে বিজেপি মুখপাত্র রাজর্ষি লাহিড়ী অবশ্য বলছেন, ‘‘আমরা কোনও লাভ-ক্ষতি দেখে রাস্তায় নেই। বাঙালি হিন্দুদের বিপন্ন অবস্থা আমাদের উদ্বিগ্ন করছে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘৫০০ বছর আগে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে যা হয়েছিল, ইসকনের সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণের সঙ্গেও তা-ই হয়েছে।’’
যদিও বিজেপির অনেক নেতা একান্ত আলোচনায় মানছেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে এ পার বাংলায় আবেগ রয়েছে। কলোনি এলাকার বহু মানুষ এই পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারবেন। ফলে সঙ্ঘবদ্ধ করার প্রশ্নে কর্মসূচি করতে হচ্ছে। এ কথা ঠিক যে, গত কয়েকটি ভোটে বিজেপি যেমন বঙ্গ রাজনীতিতে ‘হিন্দু-মুসলমান’ বা ‘৭০ শতাংশ-৩০ শতাংশ’-এর কথা বলেছে, তেমন তৃণমূলও ‘বাঙালি অস্মিতা’কে জাগিয়ে বিজেপিকে ‘বহিরাগত’ প্রমাণ করার রাজনৈতিক আখ্যান তুলে ধরেছিল। বিজেপির অনেকে মনে করছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ‘বিপন্নতা’ নিয়ে বাংলায় আন্দোলন জারি রাখতে পারলে তৃণমূলের বাংলা ও বাঙালির রাজনীতিকে ‘ধাক্কা’ দেওয়া যাবে। তবে সে জন্য সাংগঠনিক জোর কতটা রয়েছে, তা নিয়েও সংশয়ের কথা গোপন করছেন না পদ্মশিবিরের প্রথম সারির নেতারা। কারণ, আন্দোলন আর ভোটবাক্সে তার প্রতিফলন যে ঐকিক নিয়মে হয় না, তা বিজেপি নেতাদের অজানা নয়। আরজি কর আন্দোলনে যে নাগরিক ক্ষোভ আছড়ে পড়েছিল রাজপথে, শহরাঞ্চলে যার প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি, সদ্যসমাপ্ত উপনির্বাচনে তা কোনও ছাপ ফেলেনি। যদিও অনেকের মতে, বিজেপি যে ‘পাঠ্যক্রম’ মেনে রাজনীতি করে, তাতে আরজি কর আন্দোলন তাদের জন্য ‘উর্বর’ জমি ছিল না। তা মাসখানেকের মধ্যে প্রমাণিতও হয়েছিল। বিজেপি-ও আস্তে আস্তে রাস্তা ছাড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের বিষয়ে ‘উপযোগী উপাদান’ রয়েছে বলে মনে করছেন পদ্মশিবিরের নেতৃত্বের বড় অংশ।
শূন্যের অঙ্ক
বাংলার বিধানসভায় বাম-কংগ্রেস শূন্য। ভোট শতাংশেও তারা প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত। সেই দুই শক্তিও অঙ্ক কষেই বাংলাদেশ নিয়ে রাস্তায় নামছে। সিপিএম সরাসরি বলছে না যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ হচ্ছে। তারা সচেতন ভাবে বলছে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা ‘নির্যাতিত’। একই সঙ্গে ভারত, প্যালেস্তাইনও জুড়ে দিচ্ছে। যার অর্থ আন্তর্জাতিকতাবাদকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া। কিন্তু সিপিএম নেতারা মনে মনে যে অঙ্ক কষছেন, তা হল হিন্দু ভোট। বিশেষত কলোনি এলাকার হিন্দু ভোট। যা একটা সময়ে ছিল সিপিএমের ‘শক্ত ঘাঁটি’। কিন্তু বিজেপির আগ্রাসী রাজনীতির সামনে সেই ঘাঁটি কার্যত তছনছ হয়ে গিয়েছে। বামের ভোট ধাপে ধাপে চলে গিয়েছে রামের বাক্সে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে রাস্তায় নেমে সেই ক্ষতেই প্রলেপ দিতে চাইছে বামেরা। ৬ ডিসেম্বর প্রতি বছর ‘সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দিবস’ পালন করে বামেরা। ১৯৯২ সালের ওই দিনেই বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ বার ৬ ডিসেম্বর কলকাতায় সিপিএম যে মিছিল করতে চলেছে, তার বিষয় ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের প্রতিবাদ’।
একটা সময়ে বাংলার মুসলিম ভোটের সিংহভাগ ছিল বামেদের দখলে। ২০০৯ থেকে সেই ভোট ঢলে পড়েছিল মমতার দিকে। ক্রমে সেই ভোটই এখন তৃণমূলের পুঁজিতে পরিণত। আর হিন্দু ভোট টেনে নিয়েছে বিজেপি। যার ফলস্বরূপ জামানত রক্ষা করাই দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে বাম-কংগ্রেসের। মুসলিম ভোট ভাঙার ক্ষেত্রে অবশ্য কৌশল নিয়েছিল সিপিএম। ফুরফুরা শরিফ, আব্বাস সিদ্দিকি, নওশাদ সিদ্দিকের সামনে রেখে ভোট ভাঙার সেই কৌশল সফল হয়নি। বরং মালদহ, মুর্শিদাবাদের মতো যে যে জেলায় কংগ্রেসের সঙ্গে কিয়দংশ মুসলিম ভোট ছিল, তা-ও চলে গিয়েছে তৃণমূলের দিকে।
কংগ্রেসও বাংলাদেশ নিয়ে কর্মসূচি করছে। বেলঘরিয়ার যে তরুণ বাংলাদেশে বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ধর্মীয় কারণে আক্রান্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ, সেই সায়ন ঘোষের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে এসেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার-সহ দলের নেতারা। ফলে এটা স্পষ্ট যে, কংগ্রেসও বিরোধী পরিসরে বিজেপির সমর্থনে থাবা বসানোর কৌশল নিয়েই বাংলাদেশ নিয়ে ‘সক্রিয়’ থাকার চেষ্টা করছে। যদিও কংগ্রেসের তরুণ নেতা আশুতোষ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘বিজেপি সীমান্তে গিয়ে উত্তেজনা তৈরি করছে। কিন্তু বেলঘরিয়ায় যায়নি। তার কারণ একটাই— সায়ন বাংলাদেশে যে বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলেন, তিনি ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলিম। সেই পরিবার সায়নকে আগলে রেখেছিল। সায়নের বন্ধুই তাঁকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গেদে সীমান্তে পৌঁছে দিয়েছিলেন। বিজেপি সেটা বিপণন করতে পারবে না। তাই সায়নের বাড়িতে যায়নি।’’
তৃণমূলের অঙ্ক
বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে তৃণমূলের দলগত অবস্থান আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন মমতা। তাঁর বক্তব্য, বিদেশের ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকার যা অবস্থান নেবে, সেটাই তৃণমূলের অবস্থান। মমতা দাবি করেছেন, ভারত সরকার রাষ্ট্রপুঞ্জের সঙ্গে কথা বলে বাংলাদেশে ‘শান্তিসেনা’ পাঠাক। এ ভাবে শান্তিসেনা পাঠানো যায় কি না বা কূটনৈতিক স্তরে তেমন সুযোগ রয়েছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে তৃণমূল দলগত অবস্থান স্পষ্ট করার পরেও বাংলাদেশের বিষয়ে মন্তব্য করছে। বুধবার বাংলার শাসকদলের মুখপত্রে প্রতিবেদনের শিরোনামে লেখা হয়েছে, ‘ইউনূস সরকারের অসভ্যতা চলছে’। তৃণমূলও ‘কড়া’ কথা বলছে অঙ্ক কষেই। শাসকদলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘আমরা যদি এই অবস্থান না নিই, তা হলে বিজেপি হিন্দু ভোটে আরও মেরুকরণ করার চেষ্টা করবে। সেই সুযোগ ওদের দেওয়া হবে কেন?’’ শাসকদলের নেতারা এ-ও বলছেন যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ালে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্ষুণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ, তাঁরা ভাল করে জানেন, মমতার শাসনেই তাঁরা নিরাপদ। সীমান্তবর্তী এলাকায় বিজেপি যাতে ‘উস্কানি’ না দিতে পারে, সে দিকেও সাংগঠনিক ভাবে খেয়াল রাখতে হচ্ছে বলে দাবি শাসকদলের নেতাদের অনেকের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy