Advertisement
২০ ডিসেম্বর ২০২৪
Sealdah Division

নেই ‘বৈধ সিগন্যাল’, তবু শিয়ালদহ থেকে ছাড়ছে ট্রেন! বড়সড় বিপদের আশঙ্কায় রেলকর্মীরাই

শিয়ালদহের নিত্যযাত্রীদের বক্তব্য, প্রধানত রাতের দিকে প্ল্যাটফর্মে ঘোষণা করা হয়, অমুক লোকালের চালক এবং গার্ড, ‘কলিং অন সিগন্যাল’ দেওয়া আছে। যাত্রীদের মধ্যেও এই নিয়ে প্রশ্ন এবং সংশয় কম নেই।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ মে ২০২৪ ১৮:৪১
Share: Save:

মূল সিগন্যাল লাল। তবু গড়াচ্ছে লোকাল ট্রেনের চাকা!

না, কোনও ভূতুড়ে গল্প নয়। শিয়ালদহে হামেশাই এমন দৃশ্যের সাক্ষী হচ্ছেন যাত্রীরা। কোথাও একটা ‘গন্ডগোল’ আছে— সেই আভাস পেলেও তাঁদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হচ্ছে না, ঠিক কী কারণে এমনটা রোজ হয়!

প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে কয়েক মিটার এগিয়ে ট্রেন আবার দাঁড়িয়ে পড়ছে আর এক লাল সিগন্যালে। বেশ কয়েক মিনিট দাঁড়ানোর পর সেই সিগন্যাল সবুজ বা হলুদ হচ্ছে। তার পর ট্রেন ছেড়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিধাননগর রোড স্টেশনের দিকে। যাত্রীরা উদ্বেগে এবং সংশয়ে রয়েছেন। কিন্তু রেলকর্মীদের একাংশ এ নিয়ে ক্ষোভ জানাচ্ছেন। তাঁদের মন্তব্য, যাত্রীরা এ দৃশ্যের সাক্ষী থাকুন ক্ষতি নেই, কিন্তু তাঁরা যেন দুর্ঘটনার বলি না হন।

কোনও ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাওয়ার আগে তাকে নির্দিষ্ট জায়গায় সিগন্যাল দেখানো হয় এগিয়ে যাওয়ার জন্য। রেলের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘স্টার্টিং সিগন্যাল’। কিন্তু শিয়ালদহ মেন এবং উত্তর শাখার যাত্রীদের অভিযোগ, সেই সিগন্যালের ‘তোয়াক্কা’ না-করেই ‘আপৎকালীন সিগন্যাল’ দিয়ে ট্রেনগুলিকে প্ল্যাটফর্ম ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। আপৎকালীন সিগন্যালের অবশ্য কোনও বস্তুগত অস্তিত্ব নেই। রেলের পরিভাষায় একে বলা হয় ‘কলিং অন সিগন্যাল’। অর্থাৎ, ট্রেনের চালক (মোটরম্যান) এবং গার্ডকে নির্দিষ্ট বার্তা পাঠিয়ে ধীর গতিতে ট্রেনটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।

শিয়ালদহ স্টেশনে ওঠানামা করা নিত্যযাত্রীদের বক্তব্য, প্রধানত রাতের দিকে প্ল্যাটফর্মে ঘোষণা করা হয়, ‘‘অমুক লোকালের চালক এবং গার্ড, আপনাদের ‘কলিং অন সিগন্যাল’ দেওয়া হচ্ছে।’’ যাত্রীদের মধ্যেও এই নিয়ে প্রশ্ন এবং সংশয় কম নেই। তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, ঘোষণা করার পরেই ট্রেনের চালক কি চাকা গড়ানোর অনুমতি পেয়ে যান? রেলের অন্দরের খবর, বিষয়টি এতটাও সরল নয়। প্ল্যাটফর্মে ‘কলিং অন সিগন্যাল’-এর বিষয়টি চালক প্রথমে গার্ডকে জানান। গার্ডের কাছে রেল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বিশেষ অনুমতি আসে। তার পর কর্তৃপক্ষের বার্তা ইন্টারকমের মাধ্যমে চালকের কাছে পৌঁছে দেন গার্ড। তার পরেই গড়াতে থাকা ট্রেনের চাকা।

যাত্রীদের অভিযোগ, ‘কলিং অন সিগন্যাল’ দিয়ে ট্রেনগুলিকে সঠিক সময়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ধীর গতিতে খানিক এগিয়েই সেগুলি দীর্ঘ ক্ষণ ধরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকছে। রাত ১১টার বনগাঁ লোকাল রোজ শিয়ালদহ থেকে ধরেন গোবরডাঙার বাসিন্দা প্রীতম ঘোষ। দক্ষিণ কলকাতার একটি শপিং মলে কাজ করা প্রীতমের কথায়, ‘‘রাতের দিকে মল থেকে বেরোতে দেরি হলে কোনও কিছুই পাওয়া যায় না। কোনও ক্রমে শিয়ালদহ পৌঁছই। তার পর দৌড়ে ট্রেন ধরি। বেশির ভাগ দিনই ১০ নম্বর প্ল্যাটফর্মে দেয় এই ট্রেনটা। শিয়ালদহের ১০ নম্বর অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম থেকে অনেকটা এগিয়ে বিধাননগরের দিকে। প্রতি দিন ট্রেন ধরার জন্য দৌড়তে দৌড়তে শুনি, ১০ নম্বর প্ল্যাটফর্মের আপ বনগাঁ লোকালের ড্রাইভার এবং গার্ড আপনাদের কলিং অন সিগন্যাল দেওয়া আছে। ট্রেন ছেড়ে দিন। একেবারে সঠিক সময়ে ট্রেন ছাড়ে। কিন্তু তার পরেই দাঁড়িয়ে যায়। কেন জানি না।’’

এই আটকে থাকার নেপথ্যে রয়েছে কোন কারণ? রেলকর্মীদের একাংশের বক্তব্য, মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বিন্দুমাত্র ভুলচুক হলেই বিপদ অনিবার্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের এক কর্তা বিষয়টি বুঝিয়ে দিয়ে বলেন, “যে লোকালটি ছেড়ে যাচ্ছে, তার আগে একাধিক ট্রেন থাকছে। লাইনে অন্য গাড়ি থাকলে স্বয়ংক্রিয় ইন্টারলকিং ব্যবস্থায় সিগন্যাল লালই থাকবে। তাই বেশিরভাগ সময়েই শিয়ালদহের ১ থেকে ১০ নম্বর প্ল্যাটফর্মের সিগন্যাল লাল থাকলেও সময়ে ট্রেন ছেড়ে যাত্রীদের সাময়িক সুরাহা দিতে ‘কলিং অন সিগন্যাল’ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। খানিকটা দূরে গিয়েই সিগন্যাল সবুজ বা হলুদ না পাওয়ায় দাঁড়িয়ে পড়ছে ট্রেন।’’

কিন্তু বিপদটা কোথায়?

ওই রেল কর্তার আরও বক্তব্য, ‘‘চালক যদি ভুল করে লাল সিগন্যাল এড়িয়ে যান, তবে সামনে থাকা গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষ হতে পারে লোকাল ট্রেনটির। তবে এমন নয় যে, ‘কলিং অন সিগন্যাল’ কোনও সময়েই দেওয়া যায় না। কিন্তু তারও নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্র রয়েছে।’’ ওই রেল কর্তার দাবি, কোনও কারণে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থা অকেজো হয়ে গেলে, সিগন্যালে বৈদ্যুতিক সংযোগ না-থাকলে কিংবা অন্য কোনও আপৎকালীন প্রয়োজনে ‘কলিং অন সিগন্যাল’ দেওয়া হয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও কিছু নিয়ম কঠোর ভাবে মেনে চলতে হয় চালককে। যেমন তাঁকে স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়, অত্যন্ত ধীর গতিতে ট্রেন চলবে। লাইনে কোনও ধরনের বাধা বা প্রতিবন্ধকতা দেখা দিলে তিনি তৎক্ষণাৎ ব্রেক কষে ট্রেন দাঁড় করিয়ে দেবেন।

রেলের অন্য এক কর্মীর কথায়, ‘‘নিয়ম অনুযায়ী, কোনও লাইনে আগে থেকেই ট্রেন দেওয়া থাকলে পরে একই লাইনে এসে পড়া ট্রেনকে কলিং অন সিগন্যাল দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে অবশ্যই দু’টি ট্রেনের মধ্যে ৪৫ মিটারের দূরত্ব থাকতে হবে। দিনের বেলা লাল পতাকা দেখিয়ে এবং‌ রাতের বেলা লাল ইন্ডিকেটর দিয়ে এই সতর্কতা মেনে চলা হয়।’’

কিন্তু শিয়ালদহের মতো পূর্ব রেলের একটি সদাব্যস্ত ডিভিশনে এই বিধি কি সর্বদা মেনে চলা সম্ভব? যাত্রীদের একাংশ তো বটেই, মোটরম্যান, রেলকর্মীদের বড় অংশই বড় বিপদ ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন। অতীতে এই শিয়ালদহ ডিভিশনেই একাধিক বার দু’টি ট্রেনের কাছাকাছি চলে আসা কিংবা মৃদু সংঘর্ষের মতো ঘটনা ঘটেছে। তাতে সাময়িক শোরগোল পড়লেও ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি। এ বার তেমন কিছুরই আশঙ্কা করছেন অনেকে।

এ ব্যাপারে পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক কৌশিক মিত্রের বক্তব্য, ‘‘কলিং অন সিগন্যালের কারণে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বড় জোড় ২-৩ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকছে। তার বেশি নয়।’’ এতে কোনও ঝুঁকির সম্ভাবনা নেই বলেও দাবি করেছেন তিনি।

অন্য বিষয়গুলি:

Sealdah Division Eastern Railway Indian Railways
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy