প্রতীকী ছবি।
আবছা স্মৃতি বলছে, বৌটা খুব হাসছিল।
বলছিল, ‘‘বলেছিলাম না, মা? ঠিক পারব...।’’ পাশে বসা মাঝবয়সি মহিলা গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছিলেন, ‘‘তোর সাহস আছে বটে। না হলে এই সময়ে তোর মতো ন’মাসের পোয়াতি... এতটা রাস্তা...। আমার তো বুক কাঁপছিল। তোর ভয় করেনি?’’
একটু কি কেঁপে গেল বৌয়ের গলা? এ-দিক ও-দিক তাকিয়ে সে বলল, ‘‘হ্যাঁ মা, খুব ভয় করছিল। কিন্তু মনে হচ্ছিল, শুধু নিজের কথা ভাবলে হবে না। এদেরও তো বাঁচাতে হবে।’’ গলাটা গাঢ় হয়ে আসে। বলে চলে, ‘‘তাই শাড়িতেই বেঁধে নিলাম। ভাবলাম, আমার পেটের বাচ্চাটাকে যদি এ-যাত্রা রক্ষা করতে পারি, এদেরও বাঁচাতে পারব।’’
ইছামতীর পাড়ের এক শিউলি গাছ। এক পাশে সাতক্ষীরা। আর এক পাশে উত্তর ২৪ পরগনা। সেই নদী পেরিয়েই কয়েক সপ্তাহ ধরে লোক আসছে দলে দলে। এই প্রথম নয় অবশ্য। শুরু হয়েছিল বছর আড়াই আগে। স্বাধীনতার পরে পরেই। শুধু একতরফা আসা নয়, চলে যাওয়ার মানুষও কম ছিল না। যেন বর্ষাকালের ইছামতী। কী তার স্রোত! মাঝখানে কম ছিল সেই যাতায়াত। ফাল্গুন থেকে আবার শুরু হয়েছে। বর্ষা নামার সঙ্গে সঙ্গে জোয়ার। জোয়ান-বাচ্চা, ছেলে-মেয়ে, দুধের শিশু থেকে হাঁটতে না-পারা বুড়ি, কে নেই! চোখে দৃষ্টি নেই, মুখে ভাষা নেই। শুধু খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলেছে। বগলে পুঁটলি, মাথায় প্যাঁটরা। নিজের শিকড়টাকে কেটে মনে হয় ওই পুঁটলি-প্যাঁটরায় ঢুকিয়ে নিয়েছে ওরা। শিকড় বুঝি এ ভাবে কেটে ফেলা যায়? ভাবে গাছটা। কোথায় যাবে ওরা? শিকড় পোঁতার জন্য কোথায় আবার পাবে ভাল মাটি? কোথায় যাবে এই বৌ?
৬৭ বছর আগের এক দিন। ৭ আশ্বিন ১৩৫৯ (২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৫২)-র আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতা।
এর মধ্যেই পেটের কাপড় সরিয়ে পরম যত্নে নেকড়া জড়ানো একটা পুঁটলি বার করে আনছে বৌ। কী আছে ওই পুঁটলিতে? গয়না হবে হয়তো! সব কিছু ফেলে যারা চলে এসেছে, এটুকু ছাড়া কী-ই বা তাদের সম্বল! তা-ই বলে একহাট লোকের মধ্যে, এখানেই গয়নাগাঁটি বার করবে নাকি?
ভুল ভাবনা। পুঁটলি থেকে বেরোলেন এক মা। সঙ্গে চার ছানা-পোনা। দশপ্রহরণধারিণী। দশভুজা। অষ্টধাতুর? সকালবেলাই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। সোঁতা মাটির উপরে, শরতের হাল্কা রোদে, ঝকঝক করছে আধহাতেক সেই মূর্তি।
ইতিমধ্যে ফিরে এসেছে বৌটির স্বামী। হাঁফাচ্ছে বছর কুড়ি-বাইশের ছেলেটি। ‘‘খুঁজে পেয়েছি জেঠামশাইয়ের বাড়ি। চলো, চলো। ওরা অপেক্ষা করে রয়েছে।’’
দুর্গামূর্তি আবার কাপড়ে জড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় বৌটি। হাত ধরেন শাশুড়ি মা। তিন জনের ফের হাঁটা শুরু হয়। নতুন মাটির সন্ধানে।
দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাসও পার হয়ে যায়। সে-বার দুর্গাপুজোর দিনগুলো বড় নিরানন্দে কাটে গাছটির। কেউ আসে না তার কাছে। কুড়োয় না তার ফুল। হিমের পরশে তার বৃন্তে কুঁড়ির সংখ্যা কমে আসে। কমতে থাকে মানুষের ঢলও। তবে নতুন নতুন মানুষ। মুখ দেখে মনে হয়, নতুন জায়গায় শিকড় ছড়ানোর জন্য ভাল মাটি এখনও পায়নি তারা।
বছর পার হয়। ফের শরৎ আসে। সে-দিনও ভোরবেলা এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। শিউলি গাছের কানে এল খিলখিল হাসি। হাল্কা পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে সেই পরিচিত স্বর। থামল খুব কাছে এসে। তার ছায়ায় দাঁড়িয়ে কোল থেকে আস্তে আস্তে নামিয়ে দিল বছরখানেকের একরত্তিকে। তার পরে হেঁট হয়ে কুড়োতে শুরু করল ফুল। জীর্ণ শাড়ির আঁচলে বাঁধতে বাঁধতে নিজের মনেই বলল, ‘‘এ বারেও তো পুজো হবে না। ফুলগুলোই শুধু দেব মাকে। আজ অনেক ফুল পড়ে আছে। কাল ফের আসতে হবে।’’...
এখনও কী সুন্দর গল্প বলেন সাতাশির আশালতা! ১৯৫০ সালে যখন ঈশ্বরীপুর গ্রামে দাদাশ্বশুরের ভিটে ছেড়েছিলেন, বয়স সবে ১৮। গর্ভে প্রথম সন্তান। এ-পারে এসে বসিরহাটে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় পান। তার পরে অনেক ছিন্নমূলের মতোই, শুরু জীবনসংগ্রাম। কিন্তু সেই লড়াইয়ের গল্প বা স্বামীর সরকারি চাকরির দৌলতে কয়েক বছরের মধ্যে থিতু হওয়ার কাহিনি, এমনকি ব্যান্ডেলে নিজেদের বাড়িতে ফের দুর্গাপুজো শুরুর আখ্যানও শোনাতে অতটা উৎসাহ পান না বৃদ্ধা। অনেক বার জিজ্ঞাসা করার পরে সে দিনের অষ্টাদশী শুধু বলেন, ‘‘হ্যাঁ, দেখেছিলাম নৌকো থেকে। গ্রামের পরে গ্রাম জ্বলছে।’’
ব্যান্ডেলের বাড়ির উঠোনে প্রতিমার কাজ প্রায় সম্পূর্ণ। সে-দিকে তাকিয়ে আশালতা বলে চলেন, ‘‘যে কয়েক বছর ওখানে ছিলাম, ভাদ্র-আশ্বিনের প্রতিটা ভোরে যেতাম গাছটার কাছে। দেশটা নতুন। কিন্তু ফুলের গন্ধটা তো চেনা।’’
শিউলি সম্পর্কে একটি কিংবদন্তি বহুল প্রচলিত। নাগরাজ পারিজাতের এক কন্যা ছিল। নাম পারিজাতক। সূর্যদেব এবং সেই কন্যা পরস্পরকে ভালবাসতেন। কিন্তু পরবর্তী কালে সূর্যদেব অন্য নারীর প্রেমে পড়ে পারিজাতককে ছেড়ে চলে যান। মনের দুঃখে প্রাণত্যাগ করেন পারিজাতক। তাঁর চিতাভস্ম থেকে নাকি শিউলি গাছের জন্ম। প্রত্যাখ্যানের বেদনাই তার শাখা-প্রশাখায় কমলা বৃন্তের শ্বেতশুভ্র হয়ে ফোটে। আর সূর্যদেবের প্রতি অভিমানে সূর্যোদয়ের আগেই ঝরে পড়ে যায় সব ফুল।
আশালতার আখ্যান শুনতে শুনতে অবশ্য মনে হল, এক ছিন্নমূল বধূর অফুরান প্রাণশক্তির পদপ্রান্ত কুসুমাস্তীর্ণ করে তোলার জন্যই বুঝি এই ফুল-জন্ম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy