কখনও ঝড় বৃষ্টির মধ্যেই রাতারাতি পাহাড় ছাড়ার হুমকি। কখনও টানা তিন মাস ঘরে বসে থাকার ডাক (ঘর বেইঠো জনতা)। কখনও বা সমতলে পাল্টা বন্ধ। তরাই, ডুয়ার্সে বন্ধ গাড়ি চলাচল। জাতীয় সড়ক বন্ধ করে রাখায় সিকিমে পৌঁছনোও কখনও কখনও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে পর্যটকদের। গত সাত বছরে উত্তরবঙ্গের পাহাড়-সমতলে এ ভাবেই বন্ধ, অস্থিরতার জেরে বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েছে রাজ্যের পর্যটন শিল্প। সরকারি হিসাবে, শুধু ২০১৩ সালেই রাজনৈতিক ‘অস্থিরতা’য় উত্তরবঙ্গের পর্যটন শিল্পে ক্ষতি হয় প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। ছোট ছোট বহু সংস্থা উঠে যাওয়ার মুখে এসে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় আশার আলো দেখিয়েছে গোটা ২০১৪ সাল।
উত্তরবঙ্গে বন্ধ ‘মুক্ত’ পর্যটনে জোয়ার এসেছে ২০১৪ সালে। ধমর্ঘট, বন্ধের জন্য পর্যটকদের ভোগান্তির খবর সরকারি মহলে পৌঁছয়নি বললেই চলে। শৈলশহর দার্জিলিং থেকে ডুয়ার্স, সর্বত্রই নির্ঝঞ্ঝাটে ঘুরে বেড়ালেন দেশ বিদেশের পর্যটকেরা। ঘুরে বেড়ালেন জঙ্গল, পাহাড়, নদী থেকে শুরু করে চা বাগিচার বুকে। পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের হিসাব অনুযায়ী, চলতি ডিসেম্বর মাস অবধি প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ পর্যটক রাজ্যের এই প্রান্তে ঘুরছেন। যাঁদের মধ্যে ৪৫ হাজারের মতো বিদেশি পর্যটক। এখনও শীতের কনকনে ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে পাহাড়, সমতলে হোটেলে ঘর পাওয়াই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাত পোহালেই ইংরেজি নতুন বর্ষ, ২০১৫। সেই বছরটিতেও যাতে উত্তরবঙ্গের পর্যটন শিল্প এই ভাবেই চলে, সেই আশায় বুক বেঁধেছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। আশাবাদী সরকারি মহলও। রাজ্য পর্যটন দফতরের জয়েন্ট ডিরেক্টর (নর্থ) সুনীল অগ্রবাল বলেন, “গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর উত্তরবঙ্গের পর্যটন শিল্প অনেকটাই স্থিতিশীল। সরকারও নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পর্যটকদের সংখ্যাও বাড়ছে। আমাদের আশা, নতুন বছরও এমনটাই যাবে।” আশাবাদী ইস্টার্ন হিমালয় ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকরী সভাপতি সম্রাট সান্যালও। তিনি বলেন, “উত্তরবঙ্গকে পর্যটনকে বন্ধের আওতার বাইরে রাখার আবেদন সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছে করেছি। এর সুফল এ বছর মিলেছে।”
উত্তরবঙ্গকে তিনটি ‘টি’-র মাধ্যমে চেনেন দেশ-বিদেশের মানুষ। টি, টিম্বার এবং ট্যুরিজম। চা বাগান আর কাঠ বা টিম্বারকে অনেকটাই পিছনে ফেলে এখন কিন্তু এগিয়ে রয়েছে ট্যুরিজম। এই অঞ্চলের কয়েক লক্ষ বাসিন্দা হোটেল, রেস্তোরাঁ, গাড়ি, রিসর্ট ছাড়াও পর্যটন সংস্থার উপর নির্ভরশীল। দীর্ঘদিন ধরে এই শিল্প মোটামুটি ঠিকঠাক চললেও ছবিটা পুরোপুরি বদলে যায় ২০০৭ সালে। ওই বছরের শেষ থেকে পাহাড়ে আলাদা রাজ্যের দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। কয়েক বছরের মধ্যে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে তরাই, ডুয়ার্সে। ২০০৮ সালের জুনে রাতারাতি পর্যটকদের পাহাড় ছাড়ার কথা বলা হয়। পাহাড় ছাড়তে বাধ্য হন অনেক স্কুলের আবাসিকরাও। ভরা বৃষ্টির রাতে বিপাকে পড়েন কয়েক হাজার মানুষ। প্রায় দুই মাস অস্থিরতা চলে।
২০০৯ সাল থেকে ২০১০ সালে পুজো পর্যন্ত কম বেশি বন্ধ, ধর্মঘট ছিলই। এর মধ্যে ২০১০ সালের মে-তে পাহাড়ে খুন হন গোর্খা লিগ নেতা মদন তামাঙ্গ। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পাহাড়। পরের বছর ২০১১ সাল থেকে ডুয়ার্স জুড়ে পাল্টা আন্দোলন শুরু হয়। আলাদা রাজ্যের বিরোধিতায় আন্দোলন, বন্ধ। পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনাও ঘটে। পরের দুই বছর তার জেরে পর্যটন ব্যবসা ‘লাটে’ ওঠে। ২০১৩ সালে জুলাই থেকে তিন মাস পাহাড় বন্ধ থাকে। ধীরে ধীরে পাহাড় তো বটেই ডুয়ার্সের পর্যটন ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির মুখে পড়তে থাকেন। এতে ঘরে বাইরে ‘চাপে’র মুখে পড়ে নড়েচড়ে বসেন পাহাড়ের নেতারাও। বিভিন্ন পক্ষের মধ্যস্থতায় ডুয়ার্স আন্দোলন থামে। যার জেরে এ বছর বন্ধ মুক্ত পর্যটনের সুফল সামনে এসেছে। মাঝে চা বাগান নিয়ে দুইদিন পাহাড়ে বন্ধ থাকলেও ছাড় দেওয়া হয় পর্যটনকে।
জিটিএ-র তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত তথা মোর্চার সহকারি সম্পাদক বিনয় তামাঙ্গ বলেন, “আমাদের সব আন্দোলন এখন দিল্লিতে হবে। পাহাড়ে পর্যটনের কোনও প্রভাব পড়বে না। এ বছর তাই হয়েছে। আমরাও পর্যটকদের জন্য একাধিক প্রকল্প হাতেও নিয়েছি।”
আর আদিবাসী বিকাশ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তেজকুমার টোপ্পো বলেন, “বন্ধ হলে তার প্রভাব ডুয়ার্সের অর্থনীতিতেও পড়ে। আমাদের লোকজনেরই সমস্যা বাড়ে। গত কয়েক বছরে আমরা তা দেখছি। তাই আগামী আন্দোলনের ক্ষেত্রে পর্যটনের ছাড়কে মাথায় রাখব।”
একনজরে পর্যটন
২০০৮-২০০৯
পর্যটক- ৪ লক্ষ ৯৫ হাজার। (বিদেশি-৪৫ হাজার)
২০১০-২০১১
পর্যটক-১ লক্ষ ৪৫ হাজার। (বিদেশি-১০ হাজার)
২০১২-২০১৩
পর্যটক-৪ লক্ষ ৩০ হাজার (বিদেশি-৩০ হাজার)
২০১৪ ডিসেম্বর অবধি
পর্যটক-সাড়ে ৭ লক্ষ। (বিদেশি-৪৫ হাজার)
তথ্য: পর্যটন দফতর ও বিভিন্ন পর্যটন সংস্থা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy