Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

বদলাচ্ছে বিয়ের মেনু, খুশি টোটো সমাজ

ভাত আর গো-মাংস সেদ্ধ। সঙ্গে মাড়ুয়ার হাড়িয়া। এই সে দিন পর্যন্ত এটাই ছিল দেশের অন্যতম ক্ষুদ্র জনজাতি টোটোদের বিয়েতে অতিথি আপ্যায়নের মেনু। কম করেও হাজার দেড়েক অতিথির জন্য তিনদিন ধরে ঢালাও আয়োজন থাকত এই খাবারের। পাঁচটি গরু কিনে মাংস না খাওয়ালে বিয়ের স্বীকৃতি দিত না টোটো সমাজ। কিন্তু দিন বদলের ছোঁয়া এখন এই সমাজে।

নিলয় দাস
টোটোপাড়া (আলিপুরদুয়ার) শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৪০
Share: Save:

ভাত আর গো-মাংস সেদ্ধ। সঙ্গে মাড়ুয়ার হাড়িয়া। এই সে দিন পর্যন্ত এটাই ছিল দেশের অন্যতম ক্ষুদ্র জনজাতি টোটোদের বিয়েতে অতিথি আপ্যায়নের মেনু। কম করেও হাজার দেড়েক অতিথির জন্য তিনদিন ধরে ঢালাও আয়োজন থাকত এই খাবারের। পাঁচটি গরু কিনে মাংস না খাওয়ালে বিয়ের স্বীকৃতি দিত না টোটো সমাজ। কিন্তু দিন বদলের ছোঁয়া এখন এই সমাজে। আর প্রথা ভাঙার পক্ষে এই প্রজন্ম। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে তাই টোটোদের বিয়ের মেনুতেও এখন ডাল, নানান তরি তরকারি ও মাছের ব্যঞ্জন। আর সম্প্রতি টোটো মাতব্বরেরা রায় দিয়েছেন, বিয়েতে পাঁচটির গরুর বদলে একটি গরু, সঙ্গে পাঠা, মুরগি’র মাংস দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা যাবে। আর তাতেই বেজায় খুশি টোটো সমাজের লোকজনেরা।

টোটোদের কাইজি (মাতব্বর) ইন্দ্রজিৎ টোটো বলেছেন, “বিয়েতে নিমন্ত্রিতদের খাওয়ানোর জন্য গরু কেনার খরচ জোগাড় করতে টোটো সমাজের দরিদ্র বাসিন্দাদের জমি পর্যন্ত বন্ধক দিতে হত। এই বিশাল ব্যয় করা অনেকেরই পক্ষে সম্ভব হয় না। এছাড়া এখন অনেকেই গোমাংস পছন্দ করেন না। সব ভাবনা চিন্তা করেই এই সিদ্ধান্ত।” তিনি জানান, নেপালি ও বাঙালিদের বিয়েতে যে ধরণের খাবার খাওয়ানো হয়, এখন সেই রীতিই চালু করা হয়েছে। এতে টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। সকলেই তাতে খুশি।

টোটো সমাজের বিয়ের নিয়মকানুনও বেশ অন্যরকম। ভুটান পাহাড়ের পাদদেশে ডুয়ার্সের মাদারিহাট ব্লকের বাসিন্দা, ভারতের অন্যতম ক্ষুদ্র এই জনজাতির যুবক যুবতীরা বিয়ের আগে এক বছর একসঙ্গে থাকেন। এরপর ছেলের বাড়িতে হয় বিয়ের আয়োজন। টোটো পুরোহিত এসে মন্ত্র পাঠ করে শ্বশুরবাড়িতে কনের নতুন নামকরণ করে বিয়ের আচার শেষ করেন। বিয়ের নিমন্ত্রণ পেয়ে সমাজের লোকজন দলবেঁধে এক কলসি মাড়ুয়ার হাড়িয়া (নাম-ইউ) নিয়ে ভোজে সামিল হন। তিনদিন ধরে চলে বিয়ের উৎসব।

বেশ কয়েক বছর ধরে টোটোদের মধ্যে শিক্ষার হার বেড়েছে। অন্যান্য সমাজের বিয়ের আয়োজন দেখে নিজেদের সমাজেও তা চালুর জন্য উৎসাহিত হচ্ছেন তরুণ তরুণীরা। ইন্দ্রজিতের কথায়, “শুধু টোটো নন, এখন বাইরের লোকজনকেও বিয়েতে নিমন্ত্রণ করা হয়। তাঁদের রুচিকেও গুরুত্ব দেওয়া দরকার। তাই খাবারের আমূল পরিবর্তন ঘটানো একান্তই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।”

টোটো সমাজের কয়েকজন প্রবীণ বাসিন্দা জানান, হাড়িয়া বা ইউ ছাড়া বিয়েতে উপহারের প্রচলন কোনওদিনই ছিল না। বছর দুয়েক থেকে অনেকে আবার বর-কনেদের জন্য নানা রকমের উপহার নিয়ে আসছেন। এটাও বাধা দেওয়া হয়নি। সামনের দিকে চলতে গেলে এই ধরণের নিয়ম নীতির পরিবর্তনও জরুরি। একসময় টোটো মেয়েদের মধ্যে প্রথম মাধ্যমিক পাশ করেছিলেন সূচনা। তিনি এখন গ্রামের এক প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা। সূচনা’র কথায়, “এই পরিবর্তন হওয়াটা প্রয়োজন ছিল। এখন বিয়ে বাড়ির সুস্বাদু খাবার খেয়ে আমরা ও বাকি সমাজের লোকজন খুশি। খরচও অনেকটাই কমে গিয়েছে।”

বিয়েকে ঘিরে আরও একটা পরিবর্তন এসেছে। কিছু দিন আগে কলা গাছের আকাল শুরু হওয়ায় কলাপাতায় অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থাও তুলে দিয়েছে টোটো সমাজ। বাজার থেকে কিনে আনা শাল পাতার থালায় এখন রসনা তৃপ্তির ব্যবস্থা হয় নিমন্ত্রিতদের।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE