Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

ঘোরাচ্ছে ব্যাঙ্ক, চাষিদের ভরসা তাই মহাজন

গ্রাম থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে সরকারি ব্যাঙ্ক। অথচ পানিট্যাঙ্কির চাষিদের আজও কৃষিঋণের জন্য মহাজনের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। গ্রামের আট-দশজন ছাড়া কারও মেলেনি কিষাণ ক্রেডিট কার্ড। ফলে পাম্প সেট, ট্র্যাক্টর, ধান ঝাড়াই মেশিন, এমন নানা কৃষি সরঞ্জামে ভর্তুকিও পাচ্ছেন না তাঁরা।

কৌশিক চৌধুরী
পানিট্যাঙ্কি (খড়িবাড়ি) শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৪ ০২:০১
Share: Save:

গ্রাম থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে সরকারি ব্যাঙ্ক। অথচ পানিট্যাঙ্কির চাষিদের আজও কৃষিঋণের জন্য মহাজনের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। গ্রামের আট-দশজন ছাড়া কারও মেলেনি কিষাণ ক্রেডিট কার্ড। ফলে পাম্প সেট, ট্র্যাক্টর, ধান ঝাড়াই মেশিন, এমন নানা কৃষি সরঞ্জামে ভর্তুকিও পাচ্ছেন না তাঁরা। ব্যাঙ্কের অসহযোগিতার জন্যই তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন, অভিযোগ চাষিদের।

পানিট্যাঙ্কি কৃষক সঙ্ঘের সভাপতি দীনেশ বর্মন, সম্পাদক ভীষ্ম বর্মনেরা জানান, মাসিক ৫-১০ শতাংশ সুদেও মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে চাষিদের। এমন চড়া সুদে ১০- ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ নিয়ে, তার সুদ দিতে হিমসিম খাচ্ছেন চাষিরা। সেখানে কিষাণ ক্রেডিট কার্ড থাকলে তাঁরা বার্ষিক সাত শতাংশ সুদে ঋণ পেতে পারতেন। দীনেশবাবু বলেন, “আমাদের সদস্য সংখ্যা ৮৬ জন। অথচ কিষাণ ক্রেডিট কার্ড রয়েছে মাত্র ১০ জনের হাতে।”

কৃষি দফতর সূত্রে খবর, কেবল পানিট্যাঙ্কি নয়, এ সমস্যা রয়েছে গোটা ব্লকেই। ২০১১ সালে খড়িবাড়ি ব্লকের ১২ হাজার চাষিকে কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের আওতায় আনার কাজ শুরু হয়। কিন্তু তাঁদের অর্ধেকের উপর এখনও কার্ড পাননি। চলতি আর্থিক বছরে আরও তিন হাজার চাষিকে কার্ড দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে দফতর। আগামী ২৬ জুলাই কৃষি দফতর, নানা ব্যাঙ্কের আধিকারিক এবং ব্লক প্রশাসনের কর্তারা একটি বৈঠক করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।

ভারত-নেপাল সীমান্ত ঘেঁষা খড়িবাড়ি ব্লক কৃষির জন্য বিখ্যাত। মেচি নদীর পারে নিচু জমিতে হয় ধান, আর একটু উঁচু জমিতে বিঘার পর বিঘা ফলে সব্জি। বরবটি, পটল, ভেন্ডি, করলা, ব্রোকোলি, টমেটো, বাঁধাকপি, কোনও না কোনও সব্জির চাষ হয় বারোমাস। প্রায় সাত হাজার হেক্টর জমিতে ধান, আর দু’হাজার হেক্টর জমিতে সব্জি চাষ হয়, জানাচ্ছে কৃষি দফতর। খড়িবাড়ির সরু, লম্বাটে পটল উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত। এখানকার কৃষি উত্‌পাদন গোটা উত্তরবঙ্গ তো বটেই, নেপালের বাজারেরও একটি বড় অংশ দখল করে রয়েছে। তা হলে চাষিরা তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্য পাচ্ছেন না কেন?

কৃষক সঙ্ঘের সদস্যরা জানালেন, একটা সমস্যা জমির মালিকানা। অধিকাংশ চাষিই অন্যের জমি লিজ নিয়ে চাষ করেন তাঁরা। ফলে ব্যক্তিগত কিষাণ ক্রেডিট কার্ড মেলেনি তাঁদের। ‘জয়েন্ট লায়াবিলিটি গ্রুপ’ তৈরি করে তাঁরা কার্ড পেতে পারেন। সেই দল তৈরির জন্য ২০টি দল আবেদন পত্র জমা দিয়ে রেখেছে। ব্যাঙ্কের কর্মীরা গ্রামে এসে সরেজমিনে দেখে গ্রুপ পাশ করেন। “এতদিনে মাত্র একটি দল পাশ করেছে ব্যাঙ্ক। বাকি ১৯টা দল অপেক্ষাতেই রয়েছে,” অভিযোগ ভীষ্মদেববাবুর। যে চাষিদের জমির কাগজপত্র ঠিক রয়েছে, তাঁদেরও ব্যাঙ্ক ঘোরাচ্ছে বলে অভিযোগ। কাছাকাছি সমবায় ব্যাঙ্ক না থাকায় কৃষি সমবায় সমিতিও তৈরি করতেও পারছেন না পানিট্যাঙ্কির চাষিরা। তাঁদের সঙ্ঘ কৃষি দফতরের থেকে বীজ, শস্য রাখার গোলা, ভ্যান, এমন কিছু সুবিধে পায় কেবল।

কেন চাষিদের ঘোরাচ্ছে ব্যাঙ্ক? বাতাসির রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কটির (সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক) আঞ্চলিক প্রবন্ধক রবীন্দ্রনাথ দাস বলেন, “কিছু সমস্যা তো থাকেই। আমি নিজে কয়েকদিনের মধ্যে ব্লকে যাচ্ছি। সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করা হবে।” ব্যাঙ্কের সাফাই, বাতাসি শাখার ভারপ্রাপ্ত অফিসারের অসুস্থতার জন্য দেরি হচ্ছে। চাষিদের কিন্তু অভিযোগ, ব্যাঙ্কের নিষ্ক্রিয়তা চলছে অনেক দিন ধরে। বারবার ম্যানেজার বদল হচ্ছে বলে ‘জেএলজি’ তৈরি করার প্রক্রিয়া খানিক এগিয়ে আবার কেঁচে যাচ্ছে। “আমরা বলছি, কেবল অ্যাকাউন্ট করে কার্ড দিয়ে দিন, ঋণ দিতে হবে না। তা-ও তাঁরা করছেন না,” অভিযোগ চাষিদের।

কৃষি দফতর অবশ্য খড়িবাড়ি ব্লকের সমস্যা মেটাতে নড়েচড়ে বসেছে। ব্লক কৃষি আধিকারিক মেহেফুজ আহমেদ জানান, আদিবাসী-অধ্যুষিত এই ব্লকে জমির মালিকানার একটি বড় অংশ আদিবাসীদের হাতে রয়েছে। তাঁরা বহু চাষিকে ‘মৌখিক চুক্তি’তে লিজ দিয়ে দেন। ওই চাষি জমির কাগজপত্র ঠিকঠাক দেখাতে না পারায় ঋণ পান না।

এই সমস্যা মেটাতে ২৬ জুলাই খড়িবাড়িতে একটি বৈঠক ডাকা হয়েছে। বৈঠকে কৃষি দফতর, বিভিন্ন ব্যাঙ্কের আধিকারিক এবং প্রশাসনের কর্তারা উপস্থিত থাকবেন। যে চাষিরা যে জমিতে দীর্ঘদিন চাষ করছেন, তাদের একটি করে জমির তথ্য সম্বলিত সার্টিফিকেট দেবে কৃষি দফতর। ব্যাঙ্ক সেই কাগজের ভিত্তিতে কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ঋণ দেবে। দার্জিলিঙের জেলাশাসক পুনীত যাদবও চাষিদের দ্রুত কিষাণ ক্রেডিট কার্ড দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE