পড়ে রয়েছে পার্বতী পাহানের দেহ। ছবি: তরুণ দেবনাথ।
সরকারি উদ্যোগের অভাবে গত তিন দশকে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে সাক্ষরতা ও সামাজিক সচেতনতা শিবির হয়নি। এখনও কালিয়াগঞ্জের আদিবাসী সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ নিরক্ষর। উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ থানার মালগাঁও গ্রাম পঞ্চায়েতের বালাবন্ত আদিবাসীপাড়ায় কুসংস্কার জাঁকিয়ে বসেছে। তার জেরেই আদিবাসী অধ্যুষিত ওই গ্রামে ডাইনি সন্দেহে এক মহিলাকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে পার্বতী পাহান (৪২) নামে এক মহিলাকে ডাইনি অপবাদে তাঁরই আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের একাংশ পিটিয়ে মারেন বলে অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনাকে ঘিরে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ডান-বাম বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তাঁদের প্রশ্ন, প্রায় এক বছর ধরে পার্বতীদেবীকে বাসিন্দাদের একাংশ ডাইনি বলে অপবাদ দিয়ে চললেও জেলা পুলিশ, গোয়েন্দা ও প্রশাসনের কর্তারা কেন সে কথা জানতে পারলেন না?
এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন জেলাশাসক স্মিতা পান্ডে। তিনি বলেন, “আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের একাংশ এখনও নিরক্ষর ও তাঁদের মধ্যে সামাজিক সচেতনতার অভাব থাকায় আজও কুসংস্কার দূর হয়নি। সেই কারণেই, ডাইনি সন্দেহে ওই মহিলাকে পিটিয়ে মারা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। শীঘ্রই বালাবন্ত আদিবাসীপাড়ায় প্রশাসনের তরফে ধারাবাহিকভাবে সেমিনার করে কুসংস্কারবিরোধী প্রচার চালানো হবে। সেই সঙ্গে, পড়ুয়াদের স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যাপারেও বাসিন্দাদের পরামর্শ দেওয়া হবে।” কিন্তু এতদিন কেন প্রশাসন উদ্যোগী হয়নি, তার জবাবে জেলাশাসক কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ ওয়াকার রেজার দাবি, “ডাইনি অপবাদ দেওয়া হচ্ছে বলে ওই মহিলা বা তাঁর পরিবারের তরফে আগে জানানো হলে পুলিশ উপযুক্ত পদক্ষেপ করতে পারত।” তাঁর কথায়, “ভবিষ্যতে ডাইনি সন্দেহে খুনের ঘটনা আটকাতে জেলার ন’টি থানার বিভিন্ন আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামে পুলিশি নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে।”
বালাবন্ত আদিবাসীপাড়ায় ৭০টি আদিবাসী পরিবারে বসবাস। আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা বেশিরভাগই চাষাবাদ, দিনমজুরি করে বা ভ্যানরিকশা চালিয়ে সংসার চালান। ওই এলাকার প্রায় ৯০ শতাংশ আদিবাসীই নিরক্ষর। স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির কংগ্রেস সদস্য উত্তম রায় বলেন, “সরকারি উদ্যোগে এলাকার আদিবাসীদের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে সাক্ষরতা ও সামাজিক সচেতনতা অভিযান চালু থাকলে আদিবাসীদের মধ্যে কুসংস্কার জাঁকিয়ে বসত না। আর বিশ্বায়নের যুগে ডাইনি অপবাদ নিয়ে কাউকে মরতে হত না।”
তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক তথা কালিয়াগঞ্জের বাসিন্দা অসীম ঘোষ বাম আমলকেই দোষ দিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, “বাম সরকারের গাফিলতির জেরেই গত তিন দশকে জেলার কয়েক লক্ষ আদিবাসী এখনও সাক্ষর হওয়ার সুযোগ পাননি। সরকারি উদ্যোগে তাঁদের মধ্যে সামাজিক সচেতনতামূলক অভিযানও হয়নি। তার জেরেই এখনও আদিবাসীদের মধ্যে কুসংস্কার রয়ে গিয়েছে।” তাঁর দাবি, তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকার ধীরে ধীরে আদিবাসীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের চেষ্টা করছে।
সিপিএমের জেলা সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য অনিরুদ্ধ ভৌমিকের দাবি, বাম আমলে আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য অনেক প্রকল্প চালু ছিল। বিজ্ঞান মঞ্চের মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে কুসংস্কার বিরোধী প্রচারও চালু ছিল। কিন্তু বিরোধীদের বাধা ও এক শ্রেণির সরকারি আমলাদের অনীহার জেরে সেই কাজ পুরোপুরি শেষ করা সম্ভব হয়নি। তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতা দখল করার পর আদিবাসীদের কথা ভুলে গিয়েছে।
কালিয়াগঞ্জের কংগ্রেস বিধায়ক প্রমথনাথ রায়ের মতে, আদিবাসীদের মধ্যে কুসংস্কার দূর করতে ও তাঁদের সাক্ষর করে তুলতে সরকারি কোনও পরিকল্পনা হয়নি। তিনি বলেন, “আমি বালাবন্ত আদিবাসীপাড়ায় গিয়ে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনে জেলাশাসকের দ্বারস্থ হব।” বিজেপির জেলা সাধারণ সম্পাদক শঙ্কর চক্রবর্তী মনে করেন, “আদিবাসীদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ডান-বাম বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রাজনীতি করে গেলেও তাঁদের সাক্ষর ও সচেতন করতে উদ্যোগী হয়নি।” তিনি বলেন, “একজন মহিলাকে দীর্ঘদিন ধরে ডাইনি বলে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে, আর পুলিশ প্রশাসনের কর্তারা সেকথা জানতে পারলেন না! এটাই আশ্চর্যের বিষয়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy