শিলিগুড়ির আকাশ। —নিজস্ব চিত্র।
শহর শিলিগুড়ি। শিল্পমানচিত্রে অহল্যা-ভূমি শিলিগুড়ি। অথচ নগর রুপকারদের বোকা বানিয়ে এ শহর আয়তনে বাড়ছে, বাড়ছে জনসংখ্যায়। মাথায় উঠেছে উত্তরবঙ্গের রাজধানীর স্বঘোষিত শিরোপা।
একটা নগর গড়ে ওঠার পিছনে যে ঐতিহাসিক উপাদান থাকে তার কোনওটাই নেই শিলিগুড়ির পিছনে। দিল্লির পিছনে আছে ঐতিহাসিক উপাদান। পুরীর পেছনে আছে ধর্মীয় উপাদান। জামশেদপুর শিল্পনগরীর পিছনে আছে ইস্পাত শিল্পের ভূমিকা। শিলিগুড়ির নগর থেকে মহানগরে রূপান্তরিত হওয়ার পিছনে এই ধরনের কোনও উপাদান নেই। শিলিগুড়ি সুনামির বিপুল জলরাশির সঙ্গে ভেসে আসা পলিমাটি ও বালির জমা স্তরের মতো হঠাৎ স্বাধীনতার আর এক বিষাদঘন প্রতিক্রিয়ায় আগত বিপুল উদ্বাস্তুর স্রোত এবং উত্তরপূর্ব ভারতের পার্বত্যভূমির উপর ‘ড্রাগন’-এর অতর্কিত উষ্ণ নিশ্বাসের স্পর্শে সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনের তাগিদে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নগরী।
১৮৬৫ সালে তৎকালীন ভুটানের রাজার সঙ্গে ব্রিটিশ অধিকৃত ভারত সরকারের যে চুক্তি হয়েছিল তা সিনচুলা চুক্তি বলে খ্যাত। এই চুক্তি অনুযায়ী পূর্ব ডুয়ার্স (সঙ্কোশ নদীর পূর্ব পাড় থেকে অসমের হিমালয় পাদদেশ পর্যন্ত এবং পশ্চিম ডুয়ার্স) (তিস্তা নদীর পূর্ব পাড় থেকে সঙ্কোশ নদীর পশ্চিম পাড় পর্যন্ত ) ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়। পশ্চিম ডুয়ার্সকে বাংলার সঙ্গে যুক্ত করে তিনটি ভাগ করা হয়—
১) সদর মহকুমা - তিস্তা নদীর উভয় পাড়ের পার্বত্য অঞ্চল (সদর ময়নাগুড়ি),
২) তোর্ষা ও সঙ্কোশ নদীর মধ্যবর্তী বক্সা মহকুমা (সদর দফতর আলিপুরদুয়ার),
৩) পার্বত্য অঞ্চল (সদর দফতর ডালিংকোট), ডামপং-কালিম্পং (সদর দফতর কালিম্পং)।
১৮৬৭ সালের ১ জানুয়ারি কালিম্পং মহকুমাকে দার্জিলিংয়ের সঙ্গে যুক্ত করে দার্জিলিং জেলাকে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়—
১) সদর মহকুমা— তিস্তা নদীর উভয় পাড়ের পার্বত্য অঞ্চল। আয়তন ৯৬০ বর্গ মাইল।
২) তরাই মহকুমা। আয়তন ২৭৪ বর্গমাইল। সদর দফতর ফাঁসিদেওয়া থানার বর্তমান গ্রাম হাঁদাখাওয়া।
সে সময়ে শিলিগুড়ির কোনও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। শিলিগুড়ি ছিল জলপাইগুড়ি জেলার বৈকণ্ঠপুর পরগনার এক অখ্যাত মৌজা মাত্র।
১৮৮১ সালে নর্থবেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে মিটার গেজের লাইন, ‘দুটি পাতা আর একটি কুঁড়ি’র সাম্রাজ্যের প্রয়োজনে, শিলিগুড়ি পর্যন্ত প্রসারিত হওয়ার বছরটাকে শিলিগুড়ির জন্মবর্ষ ধরা যেতে পারে। ওই বছর শিলিগুড়ি মৌজা ও তার সংলগ্ন কিছু এলাকা জলপাইগুড়ি জেলা থেকে পৃথক করে দার্জিলিং জেলার সঙ্গে যুক্ত করা হয় এবং তরাই মহকুমার সদর দফতর হাঁদাখাওয়া থেকে স্থানান্তর করে শিলিগুড়িতে স্থাপন করা হয়। ১৮৯১ সালে কার্শিয়াংকে সদর দফতর করে তার অধীনে তরাই মহকুমাকে আনা হয়।
১৯০৭ সালে তরাই মহকুমার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলকে কার্শিয়াং মহকুমা থেকে পৃথক করে গঠন করা হয় শিলিগুড়ি মহকুমা। ১৯০১ সালে এর জনসংখ্যা ছিল ৭৮৪। উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে ৩৯২ ফুট। ভৌগোলিক অবস্থানে এর অক্ষাংশ ২৬°-৪৩ উত্তর এবং ৮৮° ২৬ দ্রাঘিমায় অবস্থিত। সদর দফতর দার্জিলিং থেকে এর দূরত্ব সড়ক পথে ৮০ কিমি (প্রায় ৫০ মাইল) এবং রেল পথে ৮২ কিলোমিটার (৫১ মাইল)।
শিলিগুড়ি শব্দটি লেপচা ও রাজবংশী শব্দের মিশ্রণ (যদিও এর ভিন্ন মতও আছে)। লেপচা ভাষায় ‘শিলি’ শব্দের অর্থ যেখানে প্রচুর বৃষ্টি হয়। ‘গুড়ি’র অর্থ রাজবংশী ভাষায় হাট। উত্তরবঙ্গের এই সব এলাকায় লেপচা ও রাজবংশী শব্দের মিশ্রণে বহু স্থান নাম আছে।
১৯৩৮ সালের ১৬ মার্চ শিলিগুড়িতে গঠিত হয়েছিল ইউনিয়ন বোর্ড। তার সভাপতি ছিলেন জর্জ মোহবার্ট। সেই সময় এখানে জনবসতি ছিল ৮৫৪৯ জনের।
১৯৪১ সালে ৮টি ওয়ার্ড নিয়ে হিলকোর্ট বোডের একটি ভাড়াবাড়িতে শিলিগুড়ি পুরসভার প্রথম কাজ শুরু হয়েছিল। প্রথম পুরপ্রধান ছিলেন মহকুমা শাসক এসএম গুহ। উপপ্রধান ব্রজেন্দ্র বসু রায়চৌধুরী।
১৯৫৭ সালে পুরপ্রতিষ্ঠানে প্রথম নির্বাচিত পুরপ্রধান ছিলেন জগদীশচন্দ্র ভট্টাচার্য। উপপ্রধান পঞ্চানন তালুকদার। তিনি বিধানসভার নির্বাচনে বিজয়ী হলে পুরপ্রধান হয়েছিলেন জীবনকৃষ্ণ দত্ত। এর পরের পুরপ্রধানেরা ছিলেন যথাক্রমে কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরী, স্বপন সরকার, অশোক ভট্টাচার্য, গঙ্গোত্রী দত্ত এবং আবার অশোক ভট্টাচার্য।
তখনকার শিলিগুড়ি শহর বলতে বোঝাত সঙ্কীর্ণ হিলকোর্ট রোড, দু পাশে গুমটি ঘরে আগত বাঙালি উদ্বাস্তুদের দোকান, মাঝখান দিয়ে ন্যারো গেজের টয় ট্রেনের লাইন, মহানন্দা নদীর উপরে লোহার ব্রিজ। মহানন্দা নদীর ও পারেই শিলিগুড়ি শহরের সীমানা শেষ। মহানন্দা নদীর এ পার থেকে দুটো সরু বিনুনির মতন ছিল সেভোক (সেবক) রোড আর বর্ধমান রোড। ছিল কিছু বাড়িঘর। মহানন্দাপাড়া, দ্বারভাঙ্গা টোলা, বাবুপাড়া, শিলিগুড়ির একমাত্র রেল স্টেশন ও তার সংলগ্ন টিকিয়া পাড়া এবং সুভাষ পল্লি। বাজার বলতে মহাবীরস্থানের বাজার। বাসিন্দা বলতে রেল কর্মচারী, কাঠের ব্যবসায়ী এবং বিহারি শ্রমিক। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে বাড়িগুলিতে জ্বলত হ্যারিকেনের আলো। দোকানগুলিতে হ্যাজাক। ৮টার আগেই নিঝুম রাস্তা।
এই টাউন স্টেশন থেকেই ছাড়ত দার্জিলিং মেল, দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের টয় ট্রেন। রোড স্টেশনের (বর্তমানের হাশমি চক) উত্তর কোণ বরাবর কালিম্পং পর্যন্ত ছিল গেলিখোলা রেললাইন।
শিলিগুড়ির প্রথম ডাকঘর স্থাপিত হয়েছিল ১৯০৭ সালে। ১৮৮৫ সালে ভিআই ফান্ড হাটে (পুরাতন মহাবীরস্থানের বাজারে) স্কট মিশন যে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিল, সেটাই শিলিগুড়ির প্রাচীনতম বিদ্যালয়।
১৮৩১ সালে জেনারেল নেপেয়ার পাহাড়ের বুক চিরে মধ্য ভারত থেকে নিয়ে আসা আদিবাসী শ্রমিকদের অমানুষিক পরিশ্রমের বিনিময়ে নির্মাণ করেছিলেন পাঙ্খাবাড়ি রোড। চা সাম্রাজ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন হয়েছিল আর একটি রাস্তা। স্থানীয় রাজবংশী সমাজ কৃষি ছেড়ে, মজুর বা শ্রমিকের কাজে আগ্রহ দেখায়নি। তাই ডুয়ার্স, দার্জিলিং ও তরাইয়ের চা বাগানে কোনও রাজবংশী শ্রমিকের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। আনতে হয়েছে পূর্ব নেপাল থেকে নেপালি শ্রমিক আর রাঁচি, বিলাশপুর, ছোটনাগপুর, ময়ূরভঞ্জ থেকে নানা মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে আদিবাসীদের। ৯ বছর ধরে এঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে যে রাস্তাটা শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত নির্মিত হয়েছিল সেটাই আজকের হিলকোর্ট (তেনজিং নোরগে) রোড। ১৮৭৮ সালে কলকাতায় ট্রামলাইন স্থাপনে সাফল্যের পর সেই টম নিলেন অ্যান্ড রামসে কোম্পানিকে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত সে সময়ে পৃথিবীর উচ্চতম রেললাইন পাতার কাজ দেওয়া হয়েছিল।
দুর্গম পাহাড়ের কঠিন পাথরের বুক চিরে এই রেললাইন পাতার কাজে অমানুষিক শ্রমের জন্য মজুর সংগ্রহ করা ছিল খুবই কঠিন। সে সময়ে কি এক রহস্যজনক কারণে এই অঞ্চলে অজানা দুর্ভিক্ষ শুরু হল। কোথাও কোনও খাদ্য না পেলেও এই রেললাইন পাতার কাজে যোগ দিলে মজুরি হিসাবে চাল বা গম পাওয়া যেত। সুচতুর ইংরেজ বানিয়ারা সে দিন রেললাইন পাতার মতো এই শ্রমসাধ্য কাজটি ‘রিলিফ অপারেশন’-এর নামে বলতে গেলে প্রায় বিনা মজুরিতে করিয়ে নিয়েছিল।
আজকের এই শিলিগুড়ি টাউনস্টেশন তখন শিলিগুড়ি জংশন। সে সময় ছিল অপূর্ব সুন্দর ভাবে সাজানো। এই স্টেশন বহু বিপ্লবী ও মনীষীর পদস্পর্শে ধন্য। এখানেই বিপ্লবী যতীন দাসের হাতে গোড়া সৈন্য বাঙালি বিপ্লবীর মুষ্ঠির প্রহারের শক্তির স্বাদ পেয়ে পালাবার পথ খুঁজে পায়নি। এই শহর পেয়েছে মহাত্মার পদস্পর্শ। হিলকার্ট রোডের শিউমঙ্গল সিং-এর কাঠের বাড়িতে রাত্রি যাপন করে জায়গাটিকে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে দিয়েছেন তিনি। এই শহরের ট্রেনেই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের মরদেহের যাত্রা। মংপু থেকে অসুস্থ বিশ্বকবি এই শহরের এই স্টেশনের মধ্যে দিয়েই যে যাত্রা করেছিলেন সেটাই ছিল কবির শেষ ভ্রমণ। এই শহর বুকের উপর দিয়ে যেমন ভগিনী নিবেদিতাকে দার্জিলিং যাবার পথে দেখেছে, তেমনই চোখের জলে দেখেছে তাঁর শেষ যাত্রাকে। এসেছেন নেতাজি, এসেছেন জওহরলাল নেহেরু। সে দিনের সেই শিলিগুড়ি শহরের রূপান্তর দেখে মনে হয় এ যেন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের সেই আরব্য উপন্যাসের আশ্চর্য ছোঁয়া।
পুরসভার আয়তন ও নগরায়নের দুর্বার গতির চাহিদা মেটাতে ৮টি ওয়ার্ডের মিউনিসিপ্যালিটি আজ ৪৭টি ওয়ার্ডের মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন। তিনমাইলের সেই ইউনিয়ন বোর্ডের ছোট্ট এক মফস্বল জনবসতি আজ রূপান্তরিত রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরে। জনসংখ্যা ৭,০৫,৫,৭৯। পুরুষ ৩,৬২,৫২৩ এবং নারী ৩,৪৩,০৫৬। এক সময়ের সবুজের শিলিগুড়ি আজ নানা রঙের ঝলমলে বহুতলের কংক্রিটের জঙ্গলের শিলিগুড়ি। শহরের মধ্যে চারটি নদী জলপ্রবাহের পরিবর্তে মশক কুলের অবাধ আবাদের জঞ্জালভূমি। সাক্ষরতার হার প্রায় ৮০ শতাংশ।
‘এই দ্যাখো, কেমন আমি বাড়ছি মামি’ বিজ্ঞাপনের মতন শিলিগুড়ি বাড়ছে শুধু নয়, সমস্ত নগর রূপকারদের হিসেবকে অগ্রাহ্য করেই এর বপুর বৃদ্ধি ঘটছে। অপরিকল্পত ভাবে। ১৯৯১-২০০১ দশকে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে নগরায়নের হার ছিল ২৭.৭৮ শতাংশ। এই রাজ্যে ২৮.০৩ শতাংশ। ১৯৬১-১৯৭১ দশকেই শিলিগুড়ির জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ৫০ শতাংশ। যা কলকাতা শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের থেকেও বেশি।
শিলিগুড়ির জনসংখ্যা বিশাল। অথচ ‘এটা আমার শহর শিলিগুড়ি’ এই আত্মশ্লাঘের মানসিকতা এখানে গড়ে ওঠেনি।এর অন্যতম কারণ এই শহরের জনসংখ্যাকে বলা যায়। অর্থনৈতিক পরিভাষায় মাইগ্রেশন (migration) বা দেশান্তরণ অথবা জনবসতি স্থানান্তর। নদীবাহিত পলিমাটি স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয়ে যে স্থলভূমি সৃষ্টি করে তার স্থিতি পেতে সময় নেয়। তেমনি শিলিগুড়ির এই আগত মানুষগুলি দেশ ভাগের বেদনাদায়ক স্মৃতিকে বুকে বয়ে এনে সেই পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি থেকে প্রাণের তাগিদে এই অচেনা ভূমিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে নিয়েছিল। তাদের স্মৃতির পর্দায় এখনও সেই ছেড়ে আসা ভিটেমাটি জীবন্ত হয়ে আছে। দেশ কোথায় জানতে চাইলে ঢাকা, ময়মনসিংহ, রঙপুর, ফরিদপুর, কুমিল্লা ইত্যাদি নাম গুলি। বিয়ের বিজ্ঞাপনে পাত্র-পাত্রীর পূর্ববঙ্গীয় পরিচয় দেশের মধ্যে সেই মানসিকতাকে প্রকাশ করে।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে এই শহরের প্রতি ১০০ জনে ৬০ জন এসেছে পূর্ববঙ্গ থেকে। বিহার থেকে এসেছে ১৭ জন। মাড়োয়ারির সংখ্যা ৮। বাকি ২৫ শতাংশের মধ্যে আছে গঙ্গার ওপারের দক্ষিণবঙ্গ, অসম এবং অন্য সব এলাকা। স্থানীয় রাজবংশী এই আগত জনস্রোতের চাপে এখান থেকে চলে গেছে অন্য এলাকায় বসতি স্থাপনে। এরা নিজভূমিতেই পরবাসীর দুঃখ চেপে মাঝেমধ্যেই নানা ক্ষোভের আগুন জ্বালাতে চাইছে। ‘এটা আমার শহর’ - এই ভাবনার জন্য যে একটা সংস্কৃতির পরিমণ্ডল গড়ে ওঠা দরকার তা এখনও গড়ে ওঠেনি।
শিলিগুড়ি বাড়ছে তার কলেবরে, মননের চাষের মধ্যে নয়। এছাড়া নগরায়ন ও নগরোন্নয়ন যে এক নয় এই মূল ভাবনাটি যে এই শহরের নগর পরিকল্পকদের মধ্যে পাওয়া যায় না।
নগরায়ন মাপা হয় জনসংখ্যায় শহরবাসী মানুষের অনুপাত দিয়ে। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, কর্ণাটক, তামিলনাড়ুর মতন রাজ্যগুলির গ্রামগুলির সঙ্গে পাকা রাস্তার সংযুক্তিকরণের হার শতকরা একশো ভাগ না হলেও এর কাছাকাছি। পশ্চিমবঙ্গে এর অনুপাত মাত্র ২৪.১৫ শতাংশ। ফলে পাঞ্জাবের মতন বহুকেন্দ্রিক রাজ্যের বৃহত্তর নগর লুধিয়ানায় মোট জনসংখ্যার ১৩.১২ শতাংশ বাস করে, সেখানে এককেন্দ্রিক রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বাস করে রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৬৩.৫ শতাংশ। এখানেই প্রয়োজন নগরোন্নয়ন। তা না হলে মানুষ আশপাশের এলাকা থেকে তাদের মূল প্রয়োজন মেটাতে শহরে ভিড় করে। এতে নগরায়ন হয়। নগরোন্নয়ন হয় না। নগরে গজিয়ে ওঠে যত্র তত্র বস্তি। পরিবেশ হয় দূষিত অথচ মানুষের প্রয়োজন মেটে না।
শিলিগুড়ির অসুখ তো এখান থেকেই। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সরকারি ভাবে এখানে কোনো বস্তির অস্তিত্বের কথা স্বীকার করা হয় নি। আজ সরকারি ভাবেই বলা হচ্ছে এই শহরে বস্তির সংখ্যা প্রায় ২০০। প্রতিদিন বিভিন্ন জেলার এমনকি গ্রাম এমনকি শহর থেকেও এখানে এসে কাজের আশায় ভিড় করে। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। নদীর চরে গড়ে উঠেছে অবৈধ বস্তি। নদী হচ্ছে এদের দাপটে মৃত। দাপট বাড়ছে জমি মাফিয়াদের। বাড়ছে চুরি, ডাকাতি ছিনতাই থেকে দেহব্যবসা। এমনকি ধর্ষণের মতন অপরাধ।
একটা শহরের স্বাস্থ্য তথা তার পরিবেশ রক্ষার মূল চাবিটি হচ্ছে পরিকল্পিত নগরায়ন। এই পরিকল্পনায় যেমন থাকবে প্রয়োজন মেটাতে আধুনিক উপকরণের বিন্যাস তেমনি এই শহরের উপকন্ঠের মুক্ত ভূমিগুলির সংরক্ষণের পরিকাঠামো। শিলিগুড়ি অস্থির হিমালয়ের ভূকম্পনের সর্বোচ্চস্তর (অর্থাৎ Scale V)-এর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। অথচ পরিকল্পনার অভাবে শিলিগুড়ির একটি অপরিকল্পিত শহর রূপে গড়ে উঠেছে। শিল্পের ধোঁয়া না থাকলেও শিলিগুড়ি শহরের আকাশে বাতাসে দূষণের করাল ছায়া। পরিবেশ বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে নাগরিক পরিবেশ বিপর্যয় (Urban Environmental Disaster)।
কেন ঘটছে? শিল্পের মানচিত্রে তো এটি এখনও অহল্যাভূমি। আজ পর্যন্ত এখনও কোনো শিল্পজগতের রামের পদস্পর্শে এই অহল্যাভূমির শাপ মুক্তি ঘটেনি। যা শিল্প আছে সেই চা শিল্প ক্রমশ মুমূর্ষু হলেও সে তো পরিবেশ বান্ধব হিসাবে তার সবুজ আঁচল বিছিয়ে রেখেছে। সেখানেও ঘটেছে নগরায়নের নামে তার বিনাশ এবং মত্ত হাতির মতন প্রোমোটার রাজ শিল্পের উন্মত্ত বিচরণ। ১৯৬৬ সালে শহর এলাকার আবাসিক অঞ্চল ছিল ৫.৯৬ শতাংশ। ১৯৮৬ সালে হয়েছিল ২৫ শতাংশ এখন প্রায় ৭৮ শতাংশ।
বায়ু প্রবাহের একটা বিজ্ঞান আছে। বিমান নির্মাণ শিল্প যেমন বিমানের নক্সায় বায়ুর প্রবাহের সেই বিজ্ঞানের নিয়মে বিমানের নক্সা করা হয় তেমনি তো বহুতল নির্মাণের অনুমোদনের সময় সেই শহরের বায়ু প্রবাহের গতি প্রকৃতিকে বিবেচনায় এনে তার অনুমোদন দেওয়ার কথা। সে ব্যাপারে কোনো ভাবনা নেই।
এই শহরের পূর্বপ্রান্তে বৈকণ্ঠপূর বনভূমি সবুজ বলয়ের প্রতিরক্ষার কাজ করত। পশ্চিম ও উত্থর পশ্চিম দিকের চা বলয়ের সবুজ চাদর ছিল (green buffer)। সেখানে প্রোমোটার রাজের হিংস্র আক্রমণে তা অদৃশ্য। গড়ে উঠেছে আবাসন প্রকল্প। নানা সংস্কৃতির ও ভাবনার মানুষ জায়গা নিচ্ছে। গড়ে উঠছে না যেমন মননের ঐক্য তেমনি শহরের এক সংস্কৃতিও জায়গা নিতে পারছে না। এছাড়া বহুতল বাড়ির জলের ক্ষুধা মেটাতে বল্গাহীন ভাবে ভূস্তরের জল যখন গভীর নলকূপের সাহায্যে তোলা হয় তখন একবারের জন্যও ভাবা হয় না হিমালয়ে এই ভূকম্পনপ্রবন এলাকার শিলাস্তরে এর কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
নিয়ন্ত্রিত আবাসিক অঞ্চলে একর প্রতি ৩০ জন মানুষের বাসস্থান হবার কথা। ইট পাথরের জঙ্গলে এখন এখানে ফ্ল্যাট পিছু গড়ে ১০/১২ টি পরিবার বাস করে। রাষ্ট্রসংঘ জনবসতির ক্ষেত্রে যে রূপরেখা দিয়েছে প্রতি হাজার জনসংখ্যায় ০.১৪ একরের মতন। সেটাও ক্রমশ সংকুচিত হয়ে চলেছে।
শহরের পরিচয় তার গতি। আন্তর্জাতিক বিধি অনুসারে ১০ থেকে ১২ শতাংশ জমি রাস্তার জন্য রাখা দরকার। শিলিগুড়িতে এর পরিমাণ মাত্র ৫ শতাংশ। ফলে জানজট বাড়ছে। গতি ধীরে হলে শুধু জ্বালানি ও সময়ের অপব্যবহার হয় তাই নয়। শামুক গতিতে চলা গাড়ির জ্বালানী থেকে বায়ুতে যুক্ত হয় শ্বাসরোধকারী গ্যাস ও কণিকা।
শিলিগুড়ির জমির ঢাল উত্তর - দক্ষিণ বরাবর প্রতি কিলোমিটারে ৩ মিটার। প্রতিটি আধুনিক নগরের গৃহ নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদনের সময় এই ঢালকে মাথায় রাখার কথা। এখানে সর্বত্র অবাধ নির্মাণের ফলে এই ঢাল ধরে জল নির্গমের স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ হয়ে যায়। এতে যে শুধু ড্রেনের জল নিষ্কাশনের পথ রুদ্ধ হয়ে জল জমছে তা নয় সামান্য বৃষ্টি হলেই শহরের নিচু এলাকাগুলি জলের তলায় চলে যায়। শিলিগুড়ি পুর এলাকার ৩৫ শতাংশ মানুষই বস্তিবাসী। এরা মূলত মহানন্দা, জোড়াপানি, ফুলেশ্বরী এলাকার ঝুপড়িবাসী। এই নদী গুলির জলপ্রবাহ রুদ্ধ হওয়ায় জল নিকাশি ব্যাবস্থার নাভিশ্বাস উঠেছে।
পুর এলাকায় মাথা পিছু জলের চাহিদা ধরা হয়েছে ৯০ লিটার। সেই হিসেবে এখন জলের চাহিদা দাঁড়ায় তিন কোটি লিটার জল। এর সরবরাহের উৎস মহানন্দা নদী ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে।
শহর এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ৩৫০ মেট্রিক টনের মতন বর্জ্য পদার্থ (Solid Waste) জমা হয়। এগুলি যেখানে জমা করা হয় তার গা ঘেঁষে এখন গড়ে উঠেছে জনবসতি। সেখানেও দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে।
তবু এই শহর শিলিগুড়িবাসীর। এর প্রতি একটা ভালোবাসা ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে একটা দায়িত্ববোধও। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই ঘোষিত হতে চলেছে পুর নির্বাচন। যে বা যে দল পুরসভার ক্ষমতায় আসুন সবাই মিলে সমস্যাগুলির পথ খোঁজার চেষ্টা করুন। হে ‘আমার শহর শিলিগুড়ি’ যেটা আজ প্রায় অনুচ্চারিত আছে সেটাই আগামী দিনে উচ্চকন্ঠে উচ্চারিত হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy