সুনসান গলির ভিতরে ছোট্ট দোকান। ভিতরে খাবারদাবার নিয়ে বসেছেন কয়েকজন। বাজছে গান। খানিক পরেই হাজির হলেন চাদর দিয়ে মাথা পর্যন্ত ঢাকা এক যুবক।
কড়া ভাষায় প্রশ্ন এল—‘কেয়া চাহিয়ে?’।
উত্তর এল তেমনই কড়া স্বরে—‘কলা’।
কথাটা শুনেই যে প্রশ্ন করছিল, তার সুর নরম হয়ে গেল। এ বার জিজ্ঞাসা করলেন,—‘কিতনা?’
‘এক।’
‘রেট আড়াই হাজার’।
সম্মতি মিলতেই ইশারায় ডাক পড়ল আরেকজনের। কাপড়ে মোড়া পাইপগান চলে এল।
এ বার প্রশ্ন—‘বিচি’?
উত্তর—লাগবে।
জবাব এল—‘একঠো ৮০ রুপিয়া।’
রাজি হলেন যুবক।
অনেকটা রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের গল্পের মতোই কোচবিহারের শহর থেকে ছোট গঞ্জ পর্যন্ত নানা এলাকাতে সত্যি সত্যিই এমন কাণ্ড নিয়মিত ঘটে থাকে বলে জানাচ্ছেন পুলিশ আধিকারিকদেরই একাংশ।
‘কলা’ মানে পিস্তল। ‘বিচি’ মানে গুলি। পুলিশ সূত্রেই জানা গিয়েছে, এ ভাবেই বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্রের রমরমা বাজার গড়ে উঠেছে। এই আগ্নেয়াস্ত্র যেমন দুষ্কৃতীরা ব্যবহার করছেন, তেমনই রাজনৈতিক দলগুলির সংঘর্ষেও আকছার ব্যবহার করা হচ্ছে। খুব সম্প্রতি কোচবিহার শহর সংলগ্ন পুণ্ডিবাড়িতেই তৃণমূলের দাপুটে নেতা নারায়ণ মহানায়ককে গুলি করে খুন করা হয়েছে। তাঁর গায়ে লাগে তিনটি গুলি। সেই সময় খোদ তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় নারায়ণবাবুর বাড়িতে গিয়ে তাঁর পরিবারকে সমবেদনা জানানোর পরে বলেছিলেন, ‘‘এত আগ্নেয়াস্ত্র কী করে আসছে? পুলিশকে সে সব উদ্ধার করতে হবে।’’ তৃণমূলের কোচবিহার ২ নম্বর ব্লকের সভাপতি পরিমল বর্মন সরাসরি বলেন, ‘‘বিজেপি আশ্রিত দুষ্কৃতীদের হাতে অনেক বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। পুলিশ সব জেনেও চুপ করে রয়েছে।’’ জেলা তৃণমূলের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষেরও বক্তব্য, ‘‘জেলায় বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র তো রয়েইছে। তবে তা রয়েছে বাম এবং বিজেপির হাতে। তার প্রমাণও বহুবার মিলেছে। পুলিশকে এই আগ্নেয়াস্ত্র আসা রোধ করতে হবে।’’
কোন অস্ত্রের কেমন দাম
ওয়ান সটার (পাইপ গান)-আড়াই হাজার টাকা
সিক্স রাউন্ড-১০ থেকে ১২ হাজার টাকা।
সেভেন এমএম-২২ হাজার টাকা
নাইন এমএম-২৭ হাজার টাকা
পাইপগানের গুলি ১ টি-৮০ টাকা
সিক্স রাউন্ডের গুলি ১ ডজন-১২০০ টাকা।
সেভেন ও নাইন এমএমের গুলি ১ ডজন-১৫০০ টাকা।
বোমা দেশি-৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
দিনহাটা থানার আবুতারায় তৃণমূলেরই জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ অনুগামীদের সঙ্গে সদ্য দলে যোগ দেওয়া উদয়ন গুহের ঘনিষ্ঠদের আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষও ঘটেছে সম্প্রতি। বিজেপির জেলার সাধারণ সম্পাদক নিখিলরঞ্জন দে-র বক্তব্য, ‘‘আবুতারার ঘটনা থেকে বোঝা যায়, তৃণমূলের কর্মীদের হাতে বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে।’’ ফরওয়ার্ড ব্লকের কোচবিহার জেলা সভাপতি পরেশ অধিকারীর সোজা কথা, ‘‘জেলায় বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র ক্রমশ বাড়ছে। এই সব আগ্নেয়াস্ত্র অন্য রাজ্য থেকে আসছে বলেই আমার কাছে খবর। তার দামও বেশি নয়। তাই বাজারও ভাল।’’ পরেশবাবুর দাবি, ‘‘সারা জেলাতেই ছড়িয়ে পড়েছে বেআইনি অস্ত্র কারবারিরা।’’
অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গেলে হয় মুখচেনা হতে হবে। অথবা জানতে হবে ‘কোড’। যেমন পিস্তলের কোড ‘কলা’। দেশি পাইপগানের নাম ‘লোকাল কলা’। তবে শুধু তাই নয়, এখানে দাম ফেললে মিলছে সেভেন এমএম, নাইন এমএম পিস্তলও। পুন্ডিবাড়িতে তৃণমূল কর্মী নারায়ণ মহানায়ককে দেশি পাইপগান থেকেই গুলি করে খুন করা হয়েছে বলে সন্দেহ করছে পুলিশ।
কোচবিহারের পুলিশ সুপার রাজেশ যাদব বলেন, “আমরা সারা বছরই আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালাই। ইতিমধ্যে বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। এখনও অভিযান চলছে। যার হাতেই থাক না কেন তা উদ্ধার করা হবে।”
কী করে শহরে ঢুকছে এই আগ্নেয়াস্ত্র? পিছনেই বা রয়েছে কারা?
পুলিশ সূত্রের খবর, কোচবিহার জেলার কিছু দাগী অপরাধী অস্ত্র কারবারের সঙ্গে জড়িত। এলাকা ভাগ করে তারা অস্ত্র ব্যবসায় নেমেছে। ছক কষে তারা নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় টাকা ফেললেই অস্ত্র মিলবে সে কথা জানিয়ে দেয়। দুষ্কৃতীদের সঙ্গে খুব সহজেই যোগাযোগ গড়ে তোলে তারা। নতুন কিছু বাজারে নামলেই খবর পৌঁছে যায় তাদের কাছে। কোনও এলাকায় রাজনৈতিক গণ্ডগোল শুরু হলেই সেখানে যোগাযোগ তৈরি করে আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রিও করে। স্থানীয় কিছু দুষ্কৃতী নিজেরাই বাড়িতে পাইপগান তৈরির কাজ করছে বলেও খবর রয়েছে পুলিশের কাছে। ওয়ান সটার নামে পরিচিত ওই আগ্নেয়াস্ত্রে একটি গুলি একবারে ভরে দেওয়া যায়। সেগুলিও তৈরি করে তারা। ছোট গাড়ির স্টিয়ারিং বা জলের পাইপ কেটে পাইপগান তৈরি করা হয়। পিতল দিয়ে তৈরি করা হয় গুলি। কোচবিহারেই তৈরি হয় বলে ওই আগ্নেয়াস্ত্রের দাম অনেকটা কম।
কী বলছে পুলিশ
আমরা সারা বছরই আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালাই। ইতিমধ্যে বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। বাইরে থেকে আগ্নেয়াস্ত্র আসা আটকাতে লাগোয়া জেলাগুলির পুলিশকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় আরও গাঢ় করা হচ্ছে।
রাজেশ যাদব
পুলিশ সুপার, কোচবিহার
এর বাইরে অন্য সমস্ত পিস্তল আসে বিহার বা অসম থেকে। পুলিশ সূত্রেরই খবর, বিহারের মুঙ্গেরে তৈরি সিক্স রাউন্ড, নাইন এমএম পিস্তলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এগুলি ছোট। সহজেই পকেটে ভরে ফেরা যায়।
বিহার থেকে শিলিগুড়ি হয়ে ডুয়ার্সের পথে ওই অস্ত্র ঢুকে যায় কোচবিহারে। গত বছর ডুয়ার্সে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের একটি বড়সড় চাঁই ধরা পড়েছিল পুলিশের হাতে। পুলিশ সূত্রেই জানা গিয়েছে, এর পরে ওই রুট কিছু দিন বন্ধ রেখে ময়নাগুড়ির রাস্তা বেছে নিয়েছিল অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। এখন আবার ‘ডুয়ার্স রুট’ চালু হয়েছে। নতুন করে সেভেন এমএম বলে একটি স্বয়ংক্রিয় পিস্তল বাজারে নামিয়েছে মুঙ্গের। ওই পিস্তলের চাহিদা এখন তুঙ্গে।
অস্ত্র আসে মুঙ্গের থেকে কাটিহার বা কিসানগঞ্জ হয়ে। তারপর ইসলামপুর হয়ে শিলিগুড়ি। সেখান থেকে কোচবিহার। প্রধানত স্থানীয় বাসে ঝোলায় অস্ত্র পুরে পাচার করা হয়। এলাকার যুবকদের সেই কাজে লাগানো হয় সামান্য টাকার বিনিময়ে। এই গোটা পথে খুব কৌশলেই পুলিশের নজর এড়িয়ে যায় পাচারকারীরা।
মায়ানমার থেকে অরুণাচল প্রদেশ হয়েও প্রচুর অস্ত্র অসমে ঢোকে। তা থেকে কিছু অস্ত্র ইদানিং কোচবিহারেও ঢুকছে বলে পুলিশ সূত্রের খবর। যদিও ওই রুট দিয়ে পাচার হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র বেশিরভাগ রাইফেল। যেগুলি জঙ্গিরা ব্যবহার করে বলে গোয়েন্দা সূত্রে খবর। গত কয়েক বছরে পুলিশের হাতে কেএলও জঙ্গি থেকে শুরু করে যে সব দুষ্কৃতীরা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে, সেগুলির বেশিরভাগ পাইপগান, সিক্স রাউন্ড ও নাইন এমএম পিস্তল।
কোচবিহারের এসপি রাজেশবাবু জানান, ‘‘বাইরে থেকে আগ্নেয়াস্ত্র আসা আটকাতে লাগোয়া জেলাগুলির পুলিশকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় আরও গাঢ় করা হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy