সঞ্জীব বর্মণ।
হাতে ‘গোল্ড মেডেল’। চোখের কোণে চিকচিক করছে জল। মঞ্চের সামনে থিকথিকে ভিড়টা হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে তাঁকে। অনেকেই উঠে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ করছেন। সে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ফের ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে তাঁর দৃষ্টি।
তিনি সঞ্জীব বর্মণ। দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে আবেগঘন গলায় তিনি বলছেন, ‘‘এই সোনার মেডেল উৎসর্গ করতে চাই মা-বাবা আর দিদিকে। ওদের জন্যই তো আমি স্নাতকোত্তরে ভাল ফল করতে পেরেছি।”
মঞ্চের সামনে তখন পিন পড়ার স্তব্ধতা। সঞ্জীব বলে চলেন, ‘‘জানেন, বাবা খেতের কাজ করে। সে বড় হাড়ভাঙা পরিশ্রম। অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। সংসারে গতি আনতে হেঁসেল-গেরস্তালি সামলেও মা বিড়ি বাঁধে। ওদের সেই উপার্জন থেকেই তো পড়াশোনা শিখেছি।”
কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরে বাংলা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে ‘গোল্ড মেডেল’ পেয়েছেন সঞ্জীব। শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তাঁর হাতে মেডেল তুলে দিয়ে উপাচার্য় দেবকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, “সঞ্জীব গরিব পরিবারের সন্তান। অনেক লড়াই করে পড়শোনা করেছেন। এমন আরও ছাত্র রয়েছেন যাঁরা এ বারে মেডেল পেয়েছেন।”
কোচবিহারের তুফানগঞ্জের নাককাটিগছে সঞ্জীবদের বাড়ি। তাঁর বাবা সুধীর বর্মণের সাকুল্যে বিঘা দুয়েক জমি রয়েছে। সেই জমিতেই চাষ-আবাদ করেন তিনি। কিন্তু চাষ আবাদ করে যে কেমন আয় হয় তা সবচেয়ে ভাল জানেন চাষিরাই। তাই নিরুপায় হয়ে হাল ধরতে হয়েছে সঞ্জীবের মা অঞ্জলীকেও। সারাদিন সংসার ঠেলে রাত জেগে বিড়ি বাঁধেন তিনি। এত কষ্টের মধ্যেও তাঁরা ছেলেকে সাহস জুগিয়েছেন। উৎসাহ দিয়েছেন, ‘তুই বাবা এ সব নিয়ে ভাবিস না। মন দিয়ে লেখাপড়াটা চালিয়ে যা।’
সঞ্জীব জানান, তাঁর মা নিরক্ষর। বাবা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু তাঁরা দু’জনেই সঞ্জীব ও তাঁর দিদি রিনাকে পড়াশোনার বিষয়ে কখনও কোনও কোনও আপস করতে দেননি। রিনাও উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘গোল্ড মেডেল’ নিয়েই বেরোন। এখন তিনি হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। সঞ্জীবের কথায়, “বাবা-মা তো সে ভাবে পড়াশোনা জানে না। তাই দিদি আমাকে পড়াত। ওর কাছেই অনেক কিছু শিখেছি। দিদির এখন বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তবে লেখাপড়ার ব্যাপারে সে কখনও খোঁজ নিতে ভোলে না।”
তুফানগঞ্জ এনএনএম হাইস্কুল থেকে পাশ করে তুফানগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হন সঞ্জীব। সেখান থেকে পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ছোট থেকেই কৃতী ছাত্র সঞ্জীব। ‘স্কলারশিপ’ও পেতেন। এ দিন সঞ্জীব জানান, তিনি কোচবিহারের বাসিন্দা কথা সাহিত্যিক অমিয়ভূষণ মজুমদারের উপরে গবেষণা করতে চান। পাশাপাশি ‘নেট’ এবং ‘ডব্লিউবিসিএস’ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেও শুরু করেছেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক সাবলু বর্মণ বলেন, “সঞ্জীব খুব ভাল ছাত্র। ওঁর সাফল্যে আমরা খুশি।” সঞ্জীবের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত তাঁর গ্রামও। এ দিন সমাবর্তন থেকে বিভিন্ন বিষয়ের ৩৯ জন ছাত্রছাত্রীকে গোল্ড মেডেল এবং ৪৪ জনকে সিলভার মেডেল দেওয়া হয়। সমাবর্তনে পঞ্চানন বর্মা স্মারক সম্মান দেওয়া হয় প্রসেনজিৎ বর্মণকে।
তবে এমন আনন্দ-আবহে কিছুটা ‘অস্বস্তি’ও থেকে গেল। সমাবর্তনে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি কেন, এই প্রশ্ন তুলে আচার্য শো-কজ করেন উপাচার্যকে। সেই প্রসঙ্গে এ দিন কলকাতায় শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘উনি (রাজ্যপাল) গণতন্ত্র রক্ষার নাম করে নিজেই যদি অগণতান্ত্রিক কাজ করেন, তা হলে সেটা সমর্থনযোগ্য হবে না। উনি সম্মানীয় লোক, আইনজ্ঞ। উনি সব জিনিসই বোঝেন। কখনও কখনও অন্যের কথায় কাজ করে ফেলেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy