সাবেক ছিটমহলের বাসিন্দাদের দিনযাপন। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব
এক মাস আগে গলব্লাডারে পাথর ধরা পড়েছে। হাসপাতাল গিয়েছেন একাধিকবার। আলট্রাসোনোগ্রাফি হয়েছে। রক্ত পরীক্ষা করতে বলা হয়েছে বাইরে থেকে। কিন্তু কাজ নেই। টাকাও নেই। তাই রক্তপরীক্ষা না করতে পেরে ঘরে বসেই পেটের ব্যাথায় কাতরাচ্ছেন দিনহাটার কৃষিমেলায় সাবেক ছিটমহলের ত্রাণশিবিরের বাসিন্দা রত্না মহন্ত।
তাঁর স্বামী বিষ্ণুবাবু বলেন, “বাইরে থেকে রক্ত পরীক্ষা করতে বলা হয়েছে। টাকা নেই। কাজ খুঁজছি। কাজ পেলে টাকা পাব। তা দিয়ে স্ত্রীর চিকিৎসা করাব।” বাসিন্দাদের অভিযোগ, ছিটমহলের বিনিময়ের দশ মাস হলেও উন্নয়নের ছিটেফোঁটা হয়নি। পানীয় জলের অভাবে ঘরে ঘরে পেটের রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন বাসিন্দারা। সব মিলিয়ে পাঁচশোরও বেশি মানুষ পেটের রোগে ভুগছেন বলে দাবি। অনেকেরই গলব্লাডারে পাথর ধরা পড়েছে। এদের মধ্যে তিনজন ভর্তি রয়েছেন কোচবিহার জেলা হাসপাতালে। শিশুরাও অপুষ্টিতে ভুগছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
নানা সমস্যায় জেরবার হলদিবাড়ি ক্যাম্পের বাসিন্দারাও। এই ক্যাম্পের বাসিন্দাদের মুখপাত্র হরি বর্মন বলেন, “আমাদের জ্বালানির সমস্যাটাই মূল। শিশুদের জন্য দুধের সমস্যাও আছে। প্রয়োজনীয় শিশুখাদ্য না পাওয়ার জন্য তারা সমস্যায় ভুগছেন।”
বাসিন্দারা জানান, সপ্তাহে পাঁচ লিটার করে যে কেরোসিন তেল দেওয়া হয় তা অপ্রতুল। একেবারে কোলের শিশুদের জন্য কোনও দুধ সরবরাহ করা হয় না। মায়ের দুধ এবং স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা গরুর দুধের ওপর তারা নির্ভরশীল। কিন্তু গরুর দুধ খাওয়ানোর সাধ্য সবসময় হয় না।
কোচবিহারের জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, ছিটমহলের উন্নয়নে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এখন পর্যন্ত প্রায় ২৭ কোটি টাকা ছিটমহলের বাসিন্দাদের জন্য খরচ করা হয়েছে। এর মধ্যে ত্রাণশিবিরে পরিকাঠামো তৈরির কাজ ও বাসিন্দাদের খাবার দেওয়া রয়েছে। এর বাইরে সরকারের সাফল্য তেমন কিছু নেই। জেলাশাসক পি উল্গানাথন অবশ্য বলেন, “নির্বাচনের জন্য কাজ একটু পিছিয়ে গিয়েছে। তবে সাবেক ছিটমহলে উন্নয়নের কাজ শুরু করা হয়েছে। এখন তা এগিয়ে যাবে।”
কিন্তু কোথায় উন্নয়ন তা নিয়ে অবশ্য স্পষ্ট রূপরেখা কিছু নেই। দশ মাস আগে ছিটমহল যে অবস্থায় ছিল এখনও সেখানেই পড়ে রয়েছে। শুধু ভোটার কার্ড মিলেছে তাঁদের। নাগরিক অধিকার রক্ষা সমন্বয় কমিটির মুখ্যসমন্বয়ক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, “অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশ সাবেক ছিটমহল কোথাও উন্নয়ন কিছু হয়নি। মানুষ অতি কষ্টের মধ্যে দিন গুজরান করছে। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”
সাবেক বাংলাদেশি ছিটমহলের বাসিন্দারা জানান, দশ মাস আগে তাঁদের গ্রামে পানীয় জল বলতে ছিল টিউবওয়েল। গোটা এলাকায় রাস্তা বলতে ছিল আলপথ। কিছু কিছু জায়গায় নিজেরা মাটি কেটে রাস্তা তৈরি করেন। বিদ্যুতের আলো তাঁরা কখনও পায়নি। তিন গুণ দাম দিয়ে কেরোসিন কিনতে হত। এখনও সেই একই অবস্থাই রয়েছে। পানীয় জলের অভাব থাকায় সাবেক ছিটমহলের মানুষ পেটের রোগে ভুগছেন বহু বছর থেকেই। মশালডাঙার বাসিন্দা জয়নাল আবেদিন বলেন, “ভেবেছিলাম এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। দশ মাস হলেও তাঁর কোনও হেরফের হয়নি। এভাবে আর কতদিন বাঁচতে হবে জানি না।”
বাসিন্দাদের আরও অভিযোগ, এখনও জমি সমস্যার সমাধান না হওয়াতে তাঁরা সবসময় আতঙ্কে ভুগছেন। জমি মাফিয়ারা সক্রিয় হলে বিপদের মধ্যে পড়তে হবে তাঁদের। জমি দখল হলেও কিছু বলার থাকবে না। এক বাসিন্দা বলেন, “এখন তো সব জমি সরকারের অধীন রয়েছে। সেই জমি বাসিন্দাদের বন্টন করার ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আমাদের জমিতে দখলদারি ছিল। আমাদের আইনে আমরা চলতাম। এখন যে কি হবে বুঝে উঠতে পাচ্ছি না।”
গত ৩১ জুলাই ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়। গত নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ভূখন্ডে ঘেরা ভারতীয় ছিটমহলগুলি থেকে ৯২১ জন বাসিন্দা ভারতে এসেছেন। দিনহাটা, মেখলিগঞ্জ এবং হলদিবাড়িতে তিনটি ক্যাম্প করে ওই বাসিন্দাদের রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে রোগে ভুগে মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের। শুরু থেকেই ক্যাম্প নিয়ে একাধিক অভিযোগে সরব হয়েছিলেন বাসিন্দারা। ক্যাম্পে তৈরি হওয়া টিনের ঘরে চারজন বা তাঁর বেশি জনের পক্ষে থাকা কষ্টকর বলে দাবি করেন তাঁরা।
ডিসেম্বর মাসে প্রশাসনের তরফে রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হয় বাসিন্দাদের মধ্যে। ওই খাবার নিয়েও বিস্তর অভিযোগ ওঠে। প্রশাসন সূত্রের খবর, বর্তমানে একটি পরিবারের জন্য মাসে ৩০ কেজি চাল, পাঁচ কেজি ডাল, পাঁচ কেজি শর্ষের তেল, পাঁচ লিটার কেরোসিন তেল, একটি এক কেজির গুড়ো দুধের প্যাকেট এবং দু’কেজির দু’টো লবনের প্যাকেট দেওয়া হয়। একটি স্টোভও দেওয়া হয়েছে তাঁদের। ওই খাবারে অর্ধেক মাস চলে। বাকি মাসের খাবার জোগাড় করতে হিমসিম খেতে হয়।
দিনহাটা ক্যাম্পের বাসিন্দা ভারত-বাংলাদেশ ইউনাইটেড কাউন্সিলের নেতা মিজানুর রহমান বলেন, “খুব অসুবিধেয় আছি। অনেকেই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। বিশেষ করে মহিলা ও শিশু। চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে পারছে না কেউই।”
সহ প্রতিবেদন: রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy